গঙ্গাদেখে পদ্মা-মেঘনার দেশে : সম্রাট মৌলিক

গঙ্গাদেখে পদ্মা-মেঘনার দেশে : সম্রাট মৌলিক
গঙ্গাদেখে পদ্মা-মেঘনার দেশে : সম্রাট মৌলিক

ভাগিরথীর উৎস থেকে পদ্মা-মেঘনার সাগরসঙ্গম পর্যন্ত দ্বিচক্রযানে গড়িয়ে যাওয়া কোনও সামান্য কাহিনী নয়। কেউ বলবেন এ-তো এক গ্ল্যামারাস পিলগ্রিমেজ, আমরা বলি না, এ হ’ল অনন্তের অন্বেষণে ছুটে যাওয়া! স্বপ্ন সাহস পরিকল্পনা ও কল্পনাশক্তির সার্থক সমন্বয় না হলে এমন যাত্রা দিশা পায় না। এখানে সেই অসামান্য তীর্থপথ –যাত্রার স্বপ্নময় কথকতা শুনিয়েছেন সম্রাট মৌলিক

‘তিনহাজার কিমি?? অসম্ভব। অবাস্তব। আমার অনুমুতি নেই।’ অভিযানের ইতি এখানেই হতে পারতো। কিন্তু বক্তা নিজেই ইতি দিয়ে চলে গেলেন, গঙ্গায় শুদ্ধ হয়ে আকাশগঙ্গায় বিলীন হবে বলে। মা অবশ্য যাবার আগে, অফিসিয়াল পারমিশন দিয়ে গিয়েছিল। অতএব আমার এই গঙ্গা যাত্রা মহানিস্ক্রমন ছাড়া আর কিছু না। অভিযানের ঘুটি সাজিয়েছেন, চন্দন বিশ্বাস, রুট তৈরিতে দেবাশীষ (গৌতম) বর্ধন। শুরু করবো বন্ধ গঙ্গোত্রী মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে। পৌঁছতে চাই সুদূর বাংলাদেশের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। মাঝে পড়বে উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ আর সাত অথবা আটটি জেলা বাংলাদেশের।

তারিখ ঠিক হলো ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮, উপাসনার ঠান্ডা কামরায় শুরু হবে আরও এক উপাসনা। আমার নিজের পাহাড়িয়া ক্লাব আ্যরেট মাউন্টেনারিং ফাউন্ডেশন এবং সোনারপুরের প্রথিতযশা মাউন্টেনারিং ক্লাব আরোহীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন হাওড়া রেলস্টেশনে। দশ মিনিট দেরিতে ট্রেন ছেড়েছে। বোধয় ছেড়ে যাওয়ার আগে একমাত্র কন্যার হাসি আরও খানিকটা দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। আমার এই যাত্রা অগস্ত্যযাত্রা নয়। ফিরে আসার দিনক্ষণ মোটামুটি নির্দিষ্ট করেই বেড়িয়েছি। ৪৫ দিন অর্থাৎ ২৫ই মার্চের মধ্যে কলকাতায় ফিরে আসা উচিত।

অভিযানের প্রথম এক সপ্তাহ চন্দন থাকবে। ভালোবাসায় এবং অভিজ্ঞতায় চন্দন এক সপ্তাহের জন্য আমার উপাস্য হবে। আমি ওকে সেটা জানিয়ে দিয়েছিলাম ট্রেনের চাকা গড়ানোর সাথে সাথে।

চন্দন বিশ্বাস পৃথিবীর প্রথম মানুষ যে কিনা একক ভাবে দু-চাকায় ভর করে ট্রান্স-হিমালয় ট্রেল শেষ করলো। শুরুর সেদিনে এমন উপমা চোখের সামনে থাকায় আমার ইচ্ছে-প্রদীপ দীপাবলি হয়ে সেজে উঠেছিল।

জানেন তো পাপ কোনোদিন ঘাঁটতে নেই। আর ঘেঁটে ফেললে পাঁকের গন্ধে আপনার যখন বমি আসবে তখন চন্দন উদয় হয়। চন্দন আপনাকে প্রথমে খারাপ পথে টেনে নামাবে। আপনি হাসি মুখে পাপমুক্তির জন্য যোগী হবেন। আপনার সংসার ভেসে যাবে। উনি শিব হয়ে স্মিত হাসিতে আপনার ভেসে যাওয়া দেখবেন। চন্দন যদি না থাকতো তবে দু-চাকা গড়াতো না। আমি পাগলপারা হতে পারতাম না। চন্দনকে নিয়ে একটা গোটা পর্ব লেখার ইচ্ছে আছে। লেজেন্ড যেমন হয়, সুগন্ধীচন্দন সেরকমই। পেশির পরিশ্রমে ওকে পাওয়া যায়। নাহলেই ফুরুত।

হরিদ্বার ছুঁয়ে উত্তরকাশি:

পরদিন শেষ বিকেলে নির্বিঘ্নে হরিদ্বার পৌঁছলাম। রাতটা ভারত সেবাশ্রম সংঘে কাটিয়ে ভাড়া করা পেট মোটা জিপে চড়ে উত্তরকাশি। উত্তরকাশিতে ভ্রাতৃপ্রতিম এম এস রাওয়াত-এর হোটেল কাম বাড়ি হলো আমার স্থায়ী ঠিকানা। ওর বাড়িতে পৌঁছনো, থাকা, এগিয়ে যাওয়া, ফিরে আসার মহার্ঘ গল্প স্বল্প পরিসরে লেখা মুশকিল। তাই এক কথায়, কবির সুমনকে ধার নিয়ে বলি, ‘বন্ধু কি খবর বল, কতদিন দেখা হয়নি’। সম্পর্কের উচ্চতা এবার বোঝা গেল?

সকাল থেকেই উত্তরকাশি মেঘে মোড়া খামের ভেতর লুকনো চিঠি লিখে রেখেছে। পড়তে হবে আরও ১০০ কিমি দূরে পৌঁছে। গাড়ি তৈরি। আমরা তৈরি। চনমনে গাড়ির চালক। গাড়ির মাথায় আমার মেরিডা এমটিবি কে তুলে দেওয়া হয়েছে। রাওয়াত ভাই চেষ্টা করেও উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারছে না এবার। বিদায় জানবার সময় গলার স্বর একটু কেঁপে গেল বোধ হয়।

উত্তরকাশি থেকে গঙ্গোত্রী:
যন্ত্র মায়া বোঝে না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এক শ্বাসে ভাটোয়ারী। চা বিরতি আর খানিক সেদ্ধ নুডলসের প্রয়োজনে। তারপর অবাক করা নিস্তব্ধতার মধ্যে গঙ্গোত্রী মন্দির।

হে ঈশ্বর! এ কোন গঙ্গোত্রী! রাস্তা বরফে সাদা। সার সার হোটেল, দোকান, তালা ঝুলিয়ে লম্বা বিশ্রামে ব্যস্ত। ভাগীরথী বরফের ফাঁক ফোকর খুঁজে নিয়ে এগিয়ে চলছে সমতলের উদ্দেশ্যে। উষ্ণতা বোধ হয় ওরও ভালো লাগে। মন্দিরের কোলাপসিবল দরজায় তালা লাগানো। ঈশ্বর বন্দি সেখানে। তার দূত হয়ে পৌঁছতে হবে গ্রাম, শহর, সর্বত্র। নদী তুমি বেঁচে থাকবে। গর্ভস্থ্ কন্যা-ভ্রুন বাঁচবে তোমার আদরে। ‘সেভ গঙ্গা, প্রটেক্ট উইমেন’, হলো আমার এই সাইকেল যাত্রার বীজ মন্ত্র। মা গঙ্গা সাথে থেকো। যেন মন্ত্রচ্যূত না হই কখনো। দুজন মহারাজ ওই ঠান্ডায় বসে ছিলেন মন্দিরের চাতাল লাগোয়া এক ঘরে। গরম চা দিয়ে অভিষেক হলো আমার। বিজয় তিলক এঁকে দিয়ে বললেন, ‘সফল হও’।

আবহাওয়া আরও কঠিন হয়েছে। বরফপাত শুরু হলো তুমুল ভাবে। কালো রাস্তা ফর্সা হচ্ছে পলক ফেলার আগে। সাথীদের বিদায়। বিদায় গঙ্গোত্রী মন্দির। এখন থেকে আমি একা বা একক। বরফের মধ্যেই সাইকেল চালানো আর সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখানো একই ব্যাপার। আধা কিমি গিয়ে, ধপাস। চোট লাগেনি। আবার ২০০ মিটার গিয়ে ভূমি শয্যা। আচ্ছা মুশকিল তো। এই ভাবে চললে তো রাতে ভালুকে বা চিতার পেটে আমার অভিযানের সমাপ্তি। একটু হেটে এগিয়ে যাবার পর কালো পিচ রাস্তার আল পথ পাওয়া গেলো। খুউব্ সাবধানে, চালাতে হচ্ছে। বরফ কুচি বন্দুকের গুলির মতো প্রতি শ্বাসে ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভেতর। চোখের চশমাও ঢেকে যাচ্ছে ক্রমাগত। পারব কি?

পারবো কি আবার গরম কফিতে চুমুক দিতে? জানি না। জানি না বলেই এটা অভিযান। সামান্য কিছু ঘন্টার এই লড়াইতে আমি ক্ষয়ে যাচ্ছি। আর নদীর টিকে থাকার বছরভর লড়াই তাহলে কতটা ভয়ঙ্কর এখন বুঝতে পারছি। পারতেই হবে। ভেতরের অব্যয় জেদকে প্রশ্রয় দিয়ে আমাকে পৌঁছতে হবে উত্তরকাশি।

সন্ধে সাড়ে ছটায় রাওয়াত এন্ড ফ্যামিলিকে আস্বস্ত করে বসে আছি নিভৃত চৌখুপিতে। সুখি-টপ পর্যন্ত বরফের সমাদর ছিল। ভাটোয়ারী থেকে বৃষ্টি এবং শেষ কয়েক কিমি শুকনো ঠান্ডা বাতাস শরীরে মেখে নিতে নিতে উত্তরকাশি পৌঁছেছি। চন্দন এলাহী খাবারের ব্যবস্থা করেছে। মেনু বললাম না। রাগ হতে পারে কারো কারো। হাজার হোক বাঙালির দেবভূমি তো।

উত্তরকাশি বিদায়, চাম্বার জন্য:

পরের দিন ছুটি নিয়ে বিশ্রাম করেছি। পরবর্তী লক্ষ্য চাম্বা। উত্তরাখণ্ডের চাম্বা। ১০৭ কিমি। ধারাসু হয়ে যাবো। ওখানে আমার বন্ধুর টু পাইস হোটেল আছে। ওর হাতের রান্না দশটা হাতির জোর দেবে আমাকে। সক্কাল সক্কাল, দুগ্গা-দুগ্গা। ধারাসু চোখের পলকে। এক ঘন্টার পরিপূর্ণ ভোজন। মনে এবং শরীরে হেব্বি তাকত। কিন্তু খানিক এগিয়ে যে চড়াই এলো তার সামনে সব ফুস। সাইকেলের সামনে ও পেছনের চাকায় যথাক্রমে তিনটে আর আটটা গিয়ার আছে। কিন্তু চব্বিশ স্পীডের এর সাইকেল বলছে, হেটে চলো। সাইকেল বলে কি আমি মানুষ না? ঠিকই তো বলেছে। ওকে যেদিন বাড়ি নিয়ে আসি তারিখটা ছিল ১৫ই সেপ্টেম্বর। আমার একমাত্র সন্তানের জন্মদিন। সেদিন থেকে ও আমার ছোট মেয়ে। এই দাবি ও করতেই পারে। কিন্তু রাত হয়ে গেলে বিপদে পড়বো। তাই বাবা বাছা করে ওকে নিয়ে এগিয়ে চললাম আরো ওপরে, মেঘের কাছাকাছি। একটার পর একটা পাহাড়ের তীব্র বাঁক। সূর্য্য চোখ কান বুজে পশ্চিমে যাবার গাড়িতে উঠে পড়েছে। টেহ্‌রি ড্যামের সৌন্দর্য তখন আমার টাটকা স্মৃতি থেকে আবছা হয়ে এসেছে। আবছা হয়ে আসছে উত্তরাখণ্ডের সব পাহাড় আর গ্রাম। সন্ধ্যা আসবেই। হেড টর্চের আলোয় শুরু হবে নতুন হরমোন ছোটানোর খেলা। অন্ধকারের গল্প লেখা যায় না। অবশ্য বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিছু ধরা না দিলে মনের দৃষ্টি প্রসারিত হয়। লেখক পারেন। আমি না। রাত সাড়ে আটটায় পৌঁছলাম চাম্বা। চন্দন টেনশনে রক্ত চন্দন হয়ে উঠেছে। হোটেলওয়ালা গাড়ি আর লোকলস্কর নিয়ে প্রায় প্রস্তুত। আর একটু হলেই রেসকিউ অপারেশন শুরু হয়ে যেত। সেই হাস্যকর ইতিহাস নিয়ে চলতে হতো আজীবন। জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছি।

ফির্‌সে হরিদ্বার:

চাম্বা থেকে হরিদ্বার শুরুতে বেশ আরাম। কিন্তু আগরা খালের চড়াই শুরু হলে মনে হয় দুটো ডানা থাকলে ভালো হতো। আর পারা যায় না। গরমে সেদ্ধ হচ্ছি, ধুলোতে ঢেকে যাচ্ছি। যন্ত্রণার এক শেষ। এর থেকে সাইকেল নিয়ে নদীতে সাতরানো ভালো। খানিকটা হতোদ্যম হয়ে ভাত ডাল আর ডিমের অমলেট দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। চুপ করে বসে রইলাম অনেকক্ষন। এরপর ঢাল, তরোয়াল নিয়ে নেমে পড়লাম রণাঙ্গনে। হয় মন্ত্রের সাধন, নয় শরীর পতন। ওই যে ছুট লাগিয়েছি, থেমেছি আগরা খালের টপে। এবার নিশ্চিন্তির উৎরাই। শুধু গিয়ার আর ব্রেক ধরে বসে থাকো। ঋষিকেশ পর্যন্ত নো চাপ। তবে রাস্তা চওড়া হচ্ছে বলে এ কদিনে বারবার থমকাতে হয়েছে। শেষের দিকে এসেও মুক্তি পেলাম না। আরো এক ঘণ্টা পর প্রিয় হরিদ্বারের প্রিয়তম উঁচু শিব মূর্তি ডেকে বললো ‘ওয়েলকাম এগেন টু হরিদ্বার।’

দেব সংস্কৃতি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মিশ্র আগে থেকেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন। রাতে মাথা গোজার ঠাই হয়েছিল সেখানেই। তবে অসাধারণ নিরামিষ নৈশভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল হোটেল অলকানন্দায়। সৌজন্যে অমিতাভ বোস। প্রবাসী বাঙালি। থাকেন দেরাদুন। মাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। পরিচয় করাবেন আমার সাথে। সেই আলাপপর্বের প্রতি মুহূর্ত মনে করলে আমি এখনও মুগ্ধ হই। রাত সাড়ে-দশটা পর্যন্ত পরম আদরে যত্ন করেছেন। অমিতাভদা আর মাসিমা, দুজনেই বোধহয় আগামী হাজার কিমি এর ইন্ধন জুগিয়ে দিলেন। রাত সেদিন কাটলো না। তার আগেই ভোর এসে উপস্থিত। চেনা উত্তরাখন্ড ছেড়ে অচেনা উত্তরপ্রদেশে চাকা গড়াবো আমি। নাজিবাবাদ পর্যন্ত চিনি, জানি। কিন্তু তারপর?

নাগিনা – ভয় পাই

কলকাতায় বসে নামটা শুনে আমার তো ভয় ভয় করতো। কেমন প্রতিশোধ নেবার মতো নাম। কিন্তু যত পথ এগিয়েছে, নাগিন কন্যার সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করেছে। এতটাই যে এক পর্যায়ে সাইকেল থেকে ভাজ করা টুল নামিয়ে রাস্তার একপাশের বসেই পড়লাম। এতই তার রূপের ছটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু পথের টানে বেরোলে মায়া বাড়াতে নেই। আকাশে আলো থাকতে পৌঁছলাম ছোট্ট শহরের দ্বার প্রান্তে। রাস্তার বাম পাশে কিসের একটা ছোট কারখানা। এক মৌলবী সাহেব বসে আছেন আরো এক বৃদ্ধের সাথে। পুলিশ স্টেশনের খোঁজ নিতেই সাইকেল ছেড়ে কাছে আসতে বলে। সংক্ষেপে সব জানানোর পর চায়ের অনুরোধে না করতে পারি না। এমন কিছু শব্দ আর অনুভূতি সেদিন ওনাদের থেকে শুনেছিলাম যা লিখতে গেলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। ওনাদের বিদায় জানিয়ে পুলিশ থানায় এলাম।সাহায্যপ্রার্থীকে যেভাবে উপকার করলেন তার পর একটাই কথা বলা চলে, ভালো পুলিশ ছুঁলে হৃদয়ে জন্মের দাগ লেগে যায়। রাতের গরম রুটির পয়সা আমি দেইনি। নরম পুলিশ মানুষ দিয়েছিল। নাগিনা আমাকে নিরাপদ উত্তরপ্রদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল রাত জুড়ে।

ছন্দ পতন:
সাইকেল যাত্রার ভ্রমণ বৃত্তান্ত স্বল্প পরিসরে শোনানো কঠিন কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বড়, মেজ, ছোট রাস্তা ধরে হনহনিয়ে চাকা গড়িয়েছি। কখনও বদ্ধ ডোবা কখনওবা বিপুলা নদীকে পাশে রেখে এগিয়ে গিয়েছি দিনের লক্ষ্যে। কিন্তু যতটুকু দেখলাম, এই দেখার নির্যাস শুধু নিজের গভীরে কোথাও জমিয়ে রাখা যায়। বাঁধ ভাঙলে প্লাবন। তাই অভিযানের বর্ণনা, শুরুর উত্তরাখন্ড এবং শেষের প্রিয় বাংলাদেশের ব্র্যাকেটে সীমাবদ্ধ রাখি।

শুধু এটুকু বলতে চাই, মাঝের চারটি রাজ্য স্বকীয়তায় ভাস্বর। এত রং, এত ভাষা, এত আমোদ, এত বিষাদ!!! প্রতিদিন আমি মানবধর্মের উদযাপন দেখেছি। যে বিনি সুতোয় আমরা মালা হয়ে ভারত মায়ের গলা জড়িয়ে রাখি, সেই বিনি সুতোকে চাক্ষুস করেছি।

এখন আর সঠিক দিন তারিখ মনে পড়ে না। বুক ভর্তি নস্টালজিয়া। মনে হয় আবার কি ফিরে পেতে পারি নদী-জড়ানো দিনগুলো? ভাবলেই কেমন কাঁপন দিয়ে জ্বর আসে। এ জ্বর থার্মোমিটারে মাপা যায় না। ওষুধে সারে না। নিজের মুখে বাংলাদেশ বললে শরীর ধীরে ধীরে শান্ত হয়। মন উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। স্বপ্ন থেকেও সুন্দর, কল্পনার থেকেও সজীব। এমন এক দেশ যেখানে জীবন, যাপন, ভ্রমণ এবং অন্তিম লগ্নেও বিদায় শব্দটি বাংলায় বলা যায়। এমন তৃপ্তি সত্যি আগে কোনোদিন পাইনি। খেয়ে তৃপ্ত হয়েছি। কিন্তু শুধু কথা বলতে পেরে এমন তৃপ্তি! উঁহু, এ একেবারে অন্য আনকোরা অভিজ্ঞতা।

ওদের দেশ – বাংলাদেশ:

বাংলাদেশ পা রেখেছিলাম হিলি সীমান্ত হয়ে। বিএসএফ এর রক্তচক্ষু, কাস্টমসের ধমক খেয়ে আমি প্রায় নেই হয়ে গিয়েছি। ভাবছি নিজের দেশেই এই শাসন। বিদেশে গেলে বেঁধে না রাখে। ভুল ভাঙল মিনিট দশের মধ্যেই। বিজিবি (বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ) জওয়ানরা বললো,
– ভাইজান, আপনার সাইকেল আমাদের জিম্মায় থাক। কাজকর্ম সাইরা আসেন।

প্রথম অভিজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে নিজেকে সঁপে দিলাম আমার পিতৃপুরুষ বিধৌত দেশের মাটিতে। নিন্দুকের দল যত ভয় দেখিয়েছিল, ফেলে এসেছি ওপারে। সাইকেল ভ্রমণে এবার নদীর নাম পরিবর্তন হচ্ছে। পদ্মা-মেঘনার সাথে দেখা করে গঙ্গার গল্প শোনাব। আর ওদের গল্প শুনে ঋদ্ধ হতে চাই।

ইয়াবা আসে?

বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন, কাস্টমস পার করে ৫০ মিটারের মধ্যেই এক মোবাইল ফোন রিচার্জ করার দোকানে এসে দাঁড়িয়েছি। রবি সিম পেলাম ২৫০ টাকার বিনিময়ে (এখন থেকে টাকা মানে বাংলাদেশি টাকা)। দোকানির গোঁফ এখনো পুরুষ্ট হয়নি। ১৭ বছর বয়সী কাউসার ভাই বাংলাদেশের ‘ডু-জ এন্ড ডোন্টস’ গুলো পাখি পড়ার মতো পড়িয়ে দিলো। নিজের ফোন নম্বর দিয়ে বলে দিয়েছে, রণে বনে জঙ্গলে বিপদে পড়লে ওকে যেন স্মরণ করি। এ-তো মেঘ না চাইতেই জল। হাত মিলিয়ে বেরিয়ে আসি। সাইকেল ধীর গতিতে চলতে শুরু করেছে। কেমন অবশ-অবশ লাগছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে আমি এখন বাংলাদেশের রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছি। ওপার আর এপারের মিলের থেকে অমিল খোঁজার আপ্রাণ প্রয়াস না চাইলেও করেই ফেলছিলাম। এ ভাবে খানিকটা যাবার পর এক মোটরবাইক সওয়ারী আমার ঠিকুজি কুষ্টি জানতে চাইলো। চলন্ত অবস্থায় এমন জেরা আমি অনেক সামলাচ্ছি গত এক মাস ধরে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে এখনো সপ্রতিভ হতে পারছি না। এবার সরাসরি দাওয়াত এলো। ওনার সামনের কোনো এক বাজারে গার্মেন্টসের স্টোর আছে। সেখানে যেন একটু বসি। জিরিয়ে নেই। দোনমন করেও শেষে চলেই গেলাম। পৌঁছনোর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কত কত মানুষ ঘিরে ধরলো। ঠান্ডা পানীয় চলে এলো। তারপর বৃষ্টির অঝোর ধারার মতো প্রশ্ন এবং উক্তি। তবে সবটাই চূড়ান্ত আবেগে মাখা। আজ কতদূর পৌঁছতে পারবো জানি না। সময় খরচ করার মতো ধনী নই। তাই আড্ডা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে এগিয়ে চললাম নগাঁওয়ের দিকে। মাঝে জয়পুর হাটে হংসের মাংস আর পোলাও দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করেছি। পথচলতি মানুষের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে চলেছি। বিস্তীর্ণ ঘন সবুজ ধান ক্ষেত দুধারে। মাঝে অপরিসর রাস্তা। রাস্তার শরীরে অনাদর স্পষ্ট। তবে গরম তেমন নেই বলে কষ্ট হচ্ছে না। আজকে ৬৫ কিমি যেতে পারলেই নওগাঁতে পৌঁছনো যাবে। তবে সময় চলে গেছে অনেকটা। সন্ধ্যে নেমে আসছে দ্রুত। মন অশান্ত হয়ে পড়ছে তার থেকে দ্রুত গতিতে। কিন্তু এই অসম প্রতিযোগিতায় আমি হেরো পার্টি। যখন নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম, রাত তখন সাড়ে-সাতটা। বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এক বড় মাপের হোটেলে ততোধিক ছোট ঘরে আশ্রয় নিলাম। স্নান শেষে বাইরের হোটেলে কচি পাঠার বিরিয়ানি আর চাবে নিজেকে ধন্য করে সবে ঘরে ঢুকেছি। দরজায় খটখট। খুলে দেখি হোটেলের কচি ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। আগেই আলাপ হয়েছিল। অনাহুত মেহমান ঘরে ঢুকে চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করে
– ইয়াবা আসে?
– ইয়াবা কি? (বাবার জন্মেও শুনিনি)
– বলেন না। আসে কি?
কি বিপদ। ইয়েতি শুনেছি। চাইলে দু এক পিস জোগাড় করার চেষ্টা করতে পারি কিন্তু ইয়াবা!!
– ফেনসিডিল আসে?
অ, এই ব্যাপার। এবার পদ্মার পানির মতো সাফ হয়ে যায় পুরো বিষয়টা।
– না। আমি ইয়াবা নেই না।
ন্যানো সেকেন্ডেরও কম সময়ে সে দরজার বাইরে চলে যায়। তারপর একটু থমকে বলে
– রাইতে দরজা খোলবেন না। যেই হোক। বলবেন যা কথা কাল সকালে।
ওর দ্রুত লয়ে চলে যাবার দৃশ্যটা দেখলাম। ভাবছি পরের বার বাংলাদেশে এলে গুচ্ছ ইয়াবা নিয়ে আসবো। আগে মিষ্টি হাতে থাকতো, এখন ইয়াবা। জানিনা এমন কত আব্বা আর ইয়াবার কবলে আমাকে পড়তে হবে।
আজকে রাতের মতো ঘুমিয়ে পড়া যাক। লাইট অফ্। অন্ধকারে হরি হরি।

এবার রাজার শহর রাজশাহী:
নওগাঁও থেকে খালি পেটে সাইকেল চালানো শুরু করেছি। তার অন্যতম কারণ নাক ডেকে ঘুমিয়েছি সকাল ৯ টা পর্যন্ত। এরপর চিরকালীন ল্যাদের সাথে আপোষহীন লড়াই চালিয়ে সাড়ে দশটায় যাত্রার শুভারম্ভ হয়েছে। আজ গন্তব্য রাজশাহী। রাজশাহী দুটো কারণে আমাকে পাগল করে তুলছে। একটি অবশই পদ্মার দেখা পাবো বলে। আরেকটি হলো রাজশাহীর স্ট্রিট-ফুড। ইউ-টিউব দেখে দেখে আমার রসনা একদম তুঙ্গে। তবে লোভীর মতো সাইকেল ছোটানো যায় না। অতএব রাজশাহীর ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভাষা আন্দোলনে যে রক্তের ফোঁটা বান ডেকেছিল, তার সামনে পৌঁছতে পেরে, বাঙালি হিসেবে আরও একবার সার্থক হলাম। এরপর একে একে ধান গবেষণা কেন্দ্র, গম গবেষণা কেন্দ্র পার করে উঠে এলাম স্টেট হাইওয়েতে। রাস্তার কঙ্কালসার চেহারা দেখে আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঝনঝন করে উঠলো। কিন্তু উপায় নেই। কিমি’র খেলায় অভ্যস্থ খেলোয়াড় আমি। দুপুরে ‘সীমানা ছাড়িয়ে’ রেস্টুরেন্টে রাজসিক খাবার খেয়েছি। কিন্তু রাজসুখ কপালে ছিল না। ঝাঁকুনির চোটে সব অঙ্গরাজ্য খসে পড়তে থাকলো। বিকেল তখন প্রায় পাঁচটা। আর মাত্র ১২ কিমি। আলেয়া ঝড়ের থেকেও জোরে সাইকেল ছোটালাম। রাস্তা মাখনের মতো পিচ্ছিল। আধ ঘন্টায় অবশেষে রাজশাহী। পৌঁছানো মাত্র বুঝলাম, এ হলো এলিট শহর। হোটেল ঠিক করে স্ট্রিট ফুডে ঝাঁপানো ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই। কাবাবের মৌতাতে পুরো রাস্তা ম ম করছে। ডুব দিলাম সুখ সাগরে। ওখানে ভাগাড়ের পণ্য বিক্রি হয় না। তাই আজও রাজশাহীর কাবাবকে আমার স্বাদ-কোরক আরও বেশি করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখন বিশ্রাম। কাল পদ্মার সাথে দেখা হবে ঘড়ির কাঁটা ধরে। চিলতে হোটেল ঘরে একফালি তক্তপোষের ওপর শরীর ছেড়ে দিলাম। এবার তক্তপোষ আর এই স্থূল শরীর বুঝে নেবে ওদের দেওয়া নেওয়া। আমি ঘুমোতে গেলাম নিজের মতো করে। শুভ রাত্রি।

রাজশাহী থেকে লালন রাজ্য এবং ফরিদপুর:
রাজশাহী থেকে সক্কাল বেলা রওনা দিয়ে পদ্মার সাথে দেখা করে এসেছি। কুষ্টিয়া পৌঁছতে চাই। আসল লক্ষ্য অবশ্য ভিন্ন। লালন শাহ,’র কর্ম চক্ষে দেখতে চাই। লালন-গড়ে গিয়ে ওর গোরের পাশে বসতে চাই। মনের বাসনা পূরণ করার জন্য অনুরোধও থাকবে। ওই ২৩ টা গোরের পাশে আমায় জায়গা দেবে? পূর্ণ বিশ্রামের জন্য এমন বেহেস্ত্‌ আর কোথায় পাবো?
কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় এতটা পথ ছেড়ে দিতে রাজি হলেন না। লালন কে দেখবার জন্য কঠিন সংগ্রাম সাজিয়ে রেখেছিলেন অলক্ষে। ঈশ্বরদী পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছি। জুম্মাবার বলে, সব দোকান -পাট বন্ধ। মাথা গোঁজার জায়গা হলো বটে কিন্তু মোরগ পোলাও আর মুর্গি ভাজা ছাড়া আর কিছু জুটলো না। পরদিন আলু ভর্তা আর পাতলা মুসুরির ডাল সহযোগে নাস্তা শেষ করা গেল। ক্যালেন্ডারে আজ১৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধুরজন্মদিন। বাংলাদেশের শিশু দিবসও বটে। দারুন আবহাওয়া। প্রাণ আকুল করা গান শুনতে শুনতে এগিয়ে চললাম।

লালনশাহ্‌ সেতু পার হতে হলো টোটো গাড়িতে। সাইকেল নিষিদ্ধ, অথচ টোটো ছুটছে। তাতে আপত্তি নেই। দুশো টাকার গচ্চা। আজব দুনিয়া। এরপরের দুই কিমি দারুন সুন্দর। পদ্মার মেজাজ বেশ খাসা। নীল ব্যাকড্রপে নীলাভ সবুজ নদীকে আজ একটু অহংকারীই মনে হলো। হতেই পারে। যার নাম পদ্মা সে-তো আগন্তুককে অহমিকায় বিদ্ধ করতেই পারে। হটাৎ ঝাঁকুনি। সম্বিৎ ফিরলো যখন, দেখলাম আদিগন্ত প্রসারিত গর্তাভ হাইওয়ে। (গর্তাভ শব্দটা আজ জন্ম নিল। বিদেশের পথকে বেআব্রু করা ঠিক হবে না ভেবে)। এরপর বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয়ে কুষ্টিয়া পর্যন্ত সাথে এলো। কুষ্টিয়ায় যখন এসে পড়েছি, তখন লালনের মাজার শুধু সময়ের অপেক্ষা। দশ মিনিটের মধ্যে শান্ত, এঁকেবেঁকে যাওয়া পথের শেষে লালন শাহ্‌ মাজার। পার্কিংয়ে বাহনকে রেখে দ্বন্দ্ব ভরা মনে মূল ফটক পার করলাম। এরপর? পা ভার হয়ে আসে, চোখ নুন জলে পোড়ে। বিশ্বাস হয় না, এমন বাজার অভিলাষী মানুষ প্রানের হাটে এসে লালন কিনবে আজ। লালন কিনব বহু বছরের লুকিয়ে রাখা নোনতা জলে। মোম সদৃশ তার চিরকালীন বাসস্থান। এমন সাদা যে মনের সব রং মিলে মিশে যায়। গোরের কাছে এসে বসি। বসা মাত্রই মনে হলো এ এক জাদুর জগৎ। ৪২ এর পুরুষসিংহ আমি। তবু এ আমার কেমন পরিণতি? এক কোষী অ্যামিবা’র থেকেও ক্ষুদ্র। বুদবুদের মতো ক্ষণস্থায়ী আমার শারীরিক উপস্হিতি মিলিয়ে যাচ্ছে !! তুমি লালন পারও বটে। বুঝিয়ে দিলে তোমায় কেনার আগে পাত্র চাই সঠিক। ঠিক আছে। এবার ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আরবার গোরের পাশে জমি দখল নিয়ে শুয়ে পরবো চিরতরে। তখন সূঁচাগ্র মেদিনীর জন্য যুদ্ধ করো না, পরম ভালোবাসায় আপন কোরো আমায়।
লালন জাদুঘর থেকে বেড়িয়ে আসা অতো সহজ নয়। কিন্তু আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সেই কাজটা সেরে ফেললাম। তারপর দ্বিপ্রহরিক ভোজনে ব্যস্ত হয়ে তৈরি হই আজকের শেষ লক্ষস্থল ফরিদপুরের জন্য। ঘটনাবহুল এই কুষ্টিয়া থেকে ফরিদপুর যাত্রা স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। তাই ধপাস করে ফরিদপুরে নিয়ে ফেললাম আপনাদের।
আমার পিতৃপুরুষের স্মৃতি ফরিদপুরের ধুলোয় সাজানো আছে। তাই ফরিদপুর আমার কাছে এক মহা অন্বেষণ। কবি জসিমউদ্দিনের বসতবাটিতে পৌঁছে চার ঘন্টা কোমায় চলে গিয়েছিলাম। আল্লাহ্‌-তা-আলার দোয়ায় চেতন দশায় ফিরে আসতে পেরেছি।এ আর এক তীর্থ পরিক্রমা হলো আমার। দেশভাগের অনুশোচনা বোর্ডের নাই থাকতে পারে। আমার আছে। এখন থেকে আরও জোরদার হলো।

চটপট বরিশাল-বরগুনা-কুয়াকাটা:
এটা এখনের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার’চটপট’ খবরের মতো। জল জঙ্গলের দেশ বরিশাল হয়ে বরগুনা পৌঁছেছি। নিজের ইচ্ছেয় নয়। বরগুনার অধিবাসীদের জেদের কাছে হার মেনে। এই নতুন জেলা শহর থেকে পায়রা নদী পার হয়ে ৫১ কিমি প্যাডেল ঘোড়ালেই কুয়াকাটা।

বরিশালে রূপতলী বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটা হোটেলে থেকেছি। পেট ভরিয়েছি টু পাইস হোটেলের কাঠের বেঞ্চিতে বসে। মালিক নিজের হাতে ইলিশ পরিবেশন করে নিজেকে ধন্য করেছেন। রাত থেকে সকালের চা, বিলকুল মুফত।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বি এম কলেজ দেখে পৌছেছিলাম বরগুনা। শেষ ৫০ কিমি স্বপ্নের যাত্রা ছিল। বরগুনা না আসলে সত্যি বাংলাদেশ দর্শন অপূর্ণ থেকে যেত।
আত্মার থেকেও আত্মীয়তর যারা সেই বরগুনার মানুষ আমাকে বিদায় জানিয়েছে। ইলিশের জন্য বিখ্যাত পায়রা নদী পার করেছি ফেরিতে তাও প্রায়ই তিন ঘন্টা আগে। মাইলস্টোনে দেখলাম কুয়াকাটা ০২ কিমি। ধড়াস বুকে আমি ও আমার সাইকেল – ‘সিসিলে’ (ওর নাম) থমকে গেলাম। একটু দম নিয়ে শেষ বারের জন্য প্যাডেল চাপ দিলাম।
বিকেল ৪:৫২ মিনিট। দেখলাম সামনে রাস্তা নেই। শুধু অফুরন্ত, দিগন্ত বিস্তৃত জলের সাম্রাজ্য। তার মানে, বোধহয় ফুরোল আমার পথিক হওয়ার পরীক্ষা। মোবাইল ফোনের ব্যাটারির আঁচ তখন নিভু নিভু। প্রিয় মানুষটিকে লিখে পাঠালাম, ‘রাস্তা নেই, বোধহয় কুয়াকাটা পৌঁছে গিয়েছি।’

 

ওপারের উত্তর কী এসেছিল জানি না। কিন্তু একটা শূন্যতা আমাকে ডুবন্ত সূর্যের সামনে প্রশ্ন করলো
-‘এরপর?’

জানি না এরপর কী!

নদী বাঁচবে, না আমরা বাঁচবো? অভিযাত্রী হলে ভয় পেতাম না। আগেই বলেছিলাম, এ আমার মহানিস্ক্রমন। এমন মহাজাগতিক পথচলা আবার ফিরে পাবো? যদি আবার সুযোগ হয় আবার একা একা নদী দেখবো? সময় তার উত্তর দেবে ।

আমার এই অভিযানে এটা নিশ্চিত যে সুদূর গঙ্গোত্রী থেকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে নিরাপদে পৌঁছেছি। তবে মিশন কতটা সাকসেস পেলো বলতে পারবো না। অনেক দেখার ছিল, যা দেখা হয়নি। অনেক শোনার এবং শোনানোর ছিল। দুটিই হয়নি। সেই অর্থে ব্যার্থতা তার নিজের মতো জায়গা করে নিয়েছে। তবে আপসোস নেই। টুকরো টুকরো ব্যর্থতা, একজোট হলে সফলতার মতোই সুন্দর। ব্যর্থতার মধ্যেই ঝুঁকির কাহিনী আছে। বিপদের নিপুন বর্ণনা আছে। মানুষ আমরা। সবাই যুক্তি দিয়ে সাজানো বিপদের গল্প শুনতে চাই। তাতে মন বসে। চিন্তা একমুখী হয়। সফলতার গল্পে সেই জনপ্রিয়তা কোথায়? জীবনের গল্প তো ব্যর্থতার মধ্যেই নিহিত। যা সাধারণ হিসেবে মেলে না, তা কাল অতিক্রম করে এগিয়ে চলে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মোহগ্রস্থের মতো ছুটতে থাকে। তবে এই মোহ মানবজমিনকে উর্বর করেছে, করছে, করবে। উত্তর মিলে গেলে, প্রশ্নের মৃত্যু। মৃত্যু যৌক্তিক বুধ্যাঙ্কের। অতএব, হই না বারবার ব্যর্থ। সমস্ত না পারা, চোখের কোলে কালো দাগ ফেলুক। সাজানো চোখের সুরমা থেকে যা অনেক বেশি খাঁটি। কেশবিন্যাস আউলা হয়ে বাতাসের দিক চিনিয়ে দিক। হাতে গোনা আপাতসার্থক মানুষের প্রাসাদ অলিন্দে পৌঁছে রাজদণ্ড হাতে তুলে নিক ব্যর্থ মানুষের দল। পৃথিবী চলুক না তাদের এঁকে দেওয়া নির্দেশে। তবে তো বাঁচবো আগামীর আশায়।

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!