ফ্রস্টবাইট বা তূষারক্ষত : ডা: ইন্দ্রনীল সেন

ফ্রস্টবাইট বা তূষারক্ষত : ডা: ইন্দ্রনীল সেন
ফ্রস্টবাইট বা তূষারক্ষত : ডা: ইন্দ্রনীল সেন

শিরোনামেই বিষয়ের পরিচয় আছে। ফ্রস্টবাইট প্রায়শই সমূহ সঙ্কটের কারণ হয়, আর তাই আরোহীদের মধ্যে এ-ব্যাপারে প্রাথমিক জ্ঞানগম্যি থাকা জরুরি। অনেকের থাকে না, বা সময়ে স্মরণে থাকে না বলে বিপদ ঘটে। এহেন জরুরি বিষয় নিয়ে কলম ধরেছেন ডাঃ ইন্দ্রনীল সেন।

পর্বতারোহীদের অন্যতম আতঙ্ক ফ্রস্টবাইট বা তুষারক্ষত। এটি যে শুধু পর্বতারোহীদের’ই হতে পারে, এমন নয়। যে কোনো ক্ষেত্রে, হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রায় দীর্ঘক্ষন শরীরের কোনো প্রান্তীয় অংশ, যেমন হাত-পা-নাক-কান-ঠোঁট উন্মুক্ত থাকলে সেই অঙ্গে ফ্রস্টবাইট বা তুষারক্ষতের আক্রমণ হতে পারে। রাশিয়া, কানাডা, স্ক্যান্ডেনেভিয়া’র মত শীতপ্রধান অঞ্চলে সমতলেও এটি বহু মানুষকে আক্রমণ করে। ইতিহাস বলে, ১৮১৩ সালে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী’র রাশিয়া আক্রমণের সময়েই বহু সেনার তুষারক্ষত ঘটে এবং তখন’ই এক চিকিৎসক ডাঃ দোমিনিক লারে’ই প্রথম এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক আলোকপাত করেন।

ফ্রস্টবাইট বা তুষারক্ষত আসলে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অন্তিম পর্ব। মূল সমস্যাটি হল অত্যধিক শৈত্যের কারণে শরীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রক্তবাহ ধমনী ও রক্তজালিকার সঙ্কোচন এবং দেহের প্রান্তীয় অংশগুলিতে রক্তসরবরাহে বিঘ্নের কারণে কোষকলার পচন ও মৃত্যু।

ফ্রস্টবাইট বা তূষারক্ষত
ফ্রস্টবাইট বা তূষারক্ষত

আমাদের শরীর যখন বিশেষ পরিবেশে তীব্র শৈত্যের সম্মুখীন হয়, তখন তাপবিজ্ঞানের নিয়মেই সে পরিবহন, পরিচলন ও বিকিরণের মাধ্যমে বেশি বেশি করে তাপ হারাতে থাকে। তখন দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রাকে ৩৭ সেলসিয়াসে ধরে রাখতে শরীর প্রথমে চেষ্টা করে বেশী করে তাপ উৎপাদন  করতে ও শরীর থেকে তাপের ক্ষয় কমাতে। আমাদের কাঁপুনি ধরে, পেশির দ্রুত সঙ্কোচন-প্রসারণে তাপ তৈরী হয়; আমাদের রোমাঞ্চ হয়, রোমের মধ্যে বাতাস ধরা পড়ে তাপ-নিরোধক স্তর তৈরী হয়, তাপের ক্ষয় কমে। এছাড়া বিপাক-ক্রিয়ার’ও কিছু-কিছু পরিবর্তন হয় যাতে খাদ্যবস্তু’রও বিভিন্ন এনজাইমের সাহায্যে দ্রুত দহনের মাধ্যমে তাপশক্তি উৎপাদন হতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ধরে তীব্র শৈত্য চলতে থাকলে তখন এত সব করেও অবস্থা সামাল দেওয়া যায়না। সমস্যা শুরু হয়। শরীর তখন শুরু করে তাপের রেশনিং। পরিবেশে তাপ ক্ষয় হচ্ছে, অতএব ‘লস’ কমাতে শরীর তখন চেষ্টা করে মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, যকৃত, বৃক্কের মত অপরিহার্য্য অঙ্গগুলিকে গরম রাখবার জন্যে হাত-পা, নাক-কান’এর মত শরীরের বাইরের দিকের অপেক্ষাকৃত কম-জরুরী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’গুলিকে ‘কাট অফ’ করে তাপ বাঁচাতে। শরীরের তাপ-সাম্য বজায় রাখে রক্ত-সংবহন, সুতরাং তাপ খরচ কমাতে অঙ্গগুলোতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করো। ব্যাস, শুরু হল রক্তবাহ ধমনী ও রক্তজালিকার সঙ্কোচন, অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ, কোষকলার মৃত্যু, পচন ও গ্যাংগ্রিন। এর সঙ্গে আবার অনেক সময়ে যোগ হয় খুব আঁটোসাঁটো জুতো কিংবা দস্তানার সমস্যা। এমনিতেই রক্ত সরবরাহ কমে আসছে, তার ওপরে জুতোর চাপে যদি আরো রক্তসঞ্চালন কমে যায়, তাহলে তো বিপর্যয় অনিবার্য!

এই বিপর্যয়-প্রক্রিয়ার কতকগুলি পর্যায় আছে। প্রথমটি’কে ডাক্তারী পরিভাষায় বলা হয় ‘চিলব্লেন’, অতঃপর ‘ফ্রস্টনিপ’ এবং পরিশেষে ‘ফ্রস্টবাইট’। এগুলি আসলে সবকটি’ই একটি পচন বা ‘গ্যাংগ্রিন’-এর বিভিন্ন অন্তর্বর্তী পর্যায়।

এখন এই যে কোষকলার মৃত্যু, এটা তো হঠাৎ করে এক সেকেন্ডে হয়না, ধীরে ধীরে হয়। তাই এই প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে যদি চিকিৎসা শুরু করা যায়, তাহলে আবার রক্ত-সরবরাহ চলাচল শুরু হয়ে অঙ্গটা বেঁচে যাতে পারে। অর্থাৎ চিলব্লেন বা ফ্রস্টনিপ পর্যায়ে’ই বিপদের আভাস পেয়ে চিকিৎসা শুরু করলে অনেক সময়েই অঙ্গহানি রোধ করা সম্ভব। দেরী হয়ে গেলে তখন আর ফেরানো যায়না, বিপর্যয়টা ‘ইররিভার্সেবল’ হয়ে পড়ে।

ফ্রস্টবাইটের চিকিৎসা বলতে শরীরে তাপ যোগানো, তাপের ‘লস’ কমানো এবং আক্রান্ত অঙ্গের যত্নও। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল-কোনোভাবেই সরাসরি আক্রান্ত অঙ্গ, হাত-পা বা আঙ্গুলে গরম সেঁক দিয়ে তাপ সরবরাহ করা যাবেনা। মনে রাখতে হবে ‘বরফও পোড়ায়’! অর্থাৎ আগুনে পুড়ে গেলে শরীরের কোষকলার ঠিক যে যে ক্ষতি হয়, বরফও ঠিক সেই একই ক্ষতি করে। তাই সরাসরি তুষারক্ষতে আক্রান্ত অঙ্গ’কে গরম করা মানে তাকে দুবার পোড়ানো। আর তাই তাপ সরবরাহের কাজটা করতে হবে শরীরের ভেতর থেকে। উষ্ণ তরল পানীয় এই ব্যাপারে খুব উপযোগী। শরীরে তাপ সরবরাহের পাশাপাশি শরীর থেকে তাপের ‘লস’ বন্ধ করতে হবে। তার উপায় হল আক্রান্ত’কে আপাদমস্তক তাপনিরোধক আস্তরণে মুড়ে ফেলা; সোজা কথায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্লিপিং ব্যাগে চালান করা। নিদেনপক্ষে আক্রান্ত হাত-পা গুলোকে তাপনিরোধক আবরণে জড়ানো এবং যতটা কমসম্ভব সেগুলো’কে টানাটানি করা। অসাড় অঙ্গ অসাবধানে কেটে-ছড়ে গেলে সংক্রমণ হয়ে সাড়ে-সর্বনাশ!

এরপর যেটি থাকে তা হল যত শীঘ্র সম্ভব নীচে নামিয়ে এনে ডাক্তারের হেপাজত করা। কত ডিগ্রি ফ্রস্টবাইট, কতটা ক্ষতি হয়েছে, সেটা কতটা ‘রিভার্সেবল’, আদৌ ‘রিভার্সেবল’ কি না, অঙ্গ বাদ গেলে কতটা যাবে- এসব ডাক্তারি কূটকচালি একান্তভাবে তাঁদের এক্তিয়ার, তাঁদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। তুষারক্ষত আটকাতে বা প্রতিরোধ করতে কয়েকটি চালু ওষুধের ব্যবহার এ রাজ্যের পর্বতারোহীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়। নাম করব না, তবে মনে রাখা ভালো, এগুলির কার্য্যকারিতা বহুলাংশে’ই চিকিৎসাবিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত নয়, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। হিতে-বিপরীত হবার কথাটা মনে রাখা ভালো।

এখানে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়ের কথাও একটু বলে রাখা দরকার। পাহাড়ে শীতের মোকাবিলা করার জন্যে বাঙালী পাহাড়প্রেমীদের ভ্রমণকাহিনীর দৌলতে ‘ডক্টর্স ব্র্যান্ডি’ নামক অ্যালকোহল জাতীয় ওষুধের ব্যবহার বহুলপ্রলিত। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পাহাড়ের আরামদায়ক বাংলোয় বসে, ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলে উষ্ণতার মৌতাত উপভোগ করতে করতে লেখা তথ্য, পর্বতাভিযানের কুড়ি হাজার ফুট উচ্চতায়, তুষারঝড়ের মধ্যে, তাঁবুতে বসে প্রযোজ্য নয়। সেখানে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় রক্তবাহগুলিকে প্রসারিত করে শরীরের অতীব জরুরী ‘আভ্যন্তরীণ তাপ’ বা ‘কোর হিট’-কে বাইরের দিকের অঙ্গ-প্তত্যঙ্গে বয়ে নিয়ে এসে অতি দ্রুত পরিবেশে ক্ষয় করে দেয়। এর ফলে প্রাণঘাতী ‘হাইপোথার্মিয়া’র পরিস্থিতি তৈরী হয়। ফ্রস্টবাইটে অঙ্গহানি  হলে তবু প্রাণটা থাকে, হাইপোথার্মিয়া হলে জীবনসংকট। সুতরাং পাহাড়ে অ্যালকোহল? নৈব নৈব চ!

সাধারণ পর্বতারোহী’রা কয়েকটা মূল কথা মনে রাখলেই যথেষ্ট-

(১) বরফও আগুনের মত শরীরকে পোড়ায়, সুতরাং যেভাবে আমরা আগুনের সম্পর্কে সাবধান থাকি, তেমনি বরফকেও সমীহ করে চলতে হবে। প্রবল শৈত্যে শরীরকে মোজা, দস্তানার মত তাপনিরোধক আবরণে মুড়ে তুষারক্ষত প্রতিরোধ করতে হবে।

(২)শরীরে খাদ্য ও জলাভাব হতে দেওয়া চলবেনা। ডিহাইড্রেশন শৈত্যজনিত ক্ষয়ক্ষতি অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়। পাহাড়ে খাবার তালিকায় কার্বোহাইড্রেট এর বদলে প্রোটিন ও ফ্যাট’এর মাত্রা একটু বেশি থাকা ভালো।

(৩) পাহাড়ে অনেকসময়ে কাজের প্রয়োজনে হাতের গ্লাভস খুলে কাজ করতেই হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে সবসময়ে খেয়াল রাখতে হবে কতক্ষণ খোলা রাখা হচ্ছে?  যত দীর্ঘক্ষণ হাত-পা খোলা থাকবে, তত ফ্রস্টবাইটের ভয় বেড়ে যাবে।

(৩)তুষারক্ষত হয়েছে বা হবার সম্ভাবনা আছে মনে হলে আক্তান্ত ব্যক্তিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদে নামিয়ে আনা দরকার। আধুনিক পর্বতারোহণে হেলিকপ্টার-রেসকিউ অপরিচিত বিষয় নয়। ইতিমধ্যে উষ্ণ, তরল-পুষ্টিকর পানীয় বারে বারে খাওয়ানো, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর এবং ক্ষতিগ্রস্তু অঙ্গটিকে যথাসম্ভব বাঁচানো এবং তাপনিরোধক আস্তরণে মুড়ে রাখার কাজ করে যেতে হবে। যন্ত্রণা হলে প্যারাসিটামল জাতীয় সাধারন ব্যথার ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।

(৪)আঁটোসাঁটো জুতো বা দস্তানা থাকলে তা সাবধানে খুলে ফেলতে হবে। কোনোভাবেই আক্রান্ত অঙ্গে সরাসরি তাপ প্রয়োগ করা যাবেনা। শরীর’কে ভেতর থেকেই গরম করতে হবে, বাইরে থেকে নয়।

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!