ব্লাক-আইস ট্রেক : রতনলাল বিশ্বাস

ব্লাক-আইস ট্রেক : রতনলাল বিশ্বাস
ব্লাক-আইস ট্রেক : রতনলাল বিশ্বাস

আমাদের সময়ে যাঁরা হিমালয়ের অন্দরে এবং পাশাপাশি সমুদ্রসৈকতেও প্রায় বিরামহীন পদচারণা করেছেন তাঁদের মধ্যে রতনবাবুর নাম সবার আগে এসে যাবে। আমাদের হিসেবে উচ্চগিরিবর্ত্ম অতিক্রমের ক্ষেত্রে তিনি ইতিমধ্যে ডাব্‌লসেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। বিপূলা ভারতবর্ষের দীর্ঘ সমুদ্রতটরেখা তিনি পায়ে হেঁটে পেরিয়ে গেছেন। গতবছর তিনি দেশের সীমানা পেরিয়ে পা রেখেছেন রাশিয়ার প্রান্তিক দেশ সাইবেরিয়ায়। হেঁটেছেন হিমায়িত বৈকাল হ্রদের ওপর দিয়ে। সেই অসামান্য পদযাত্রার গল্প শুনিয়েছেন এখানে, রতনলাল বিশ্বাস

পৃথিবীতে মিষ্টি জলের বড় ভাণ্ডার বৈকাল হ্রদ। সাইবেরিয়ার অন্তর্গত এই সরোবরে দুনিয়ার এক পঞ্চমাংশ জল সঞ্চিত আছে। ভূগোল বইতে এ’কটি লাইনই স্কুল জীবন থেকে সকলের মত, আমারও জানা। বছর খানেক আগে, পীযুসদা (পীযুস রায় চৌধুরী) শীতকালে জমাটবাধা বৈকাল হ্রদের উপরে ব্ল্যাক আইস ট্রেক করলেন। এই অভিযানের বিবরণ ও ছবি মনকে দারুণভাবে নাড়া দিল।বিমল দে’র শীতের সাইবেরিয়া ভ্রমণের বিবরণ পড়ে ভয় পেলেও, লাদাখে জমাটবাধা নদীর উপর দিয়ে বার দুয়েক হাঁটার পর, শীতের সাইবেরিয়ার ঠাণ্ডাকে অতটা অন্তরায় মনে হল না।দলের সকলেরই সমস্যা এক, এতগুলি টাকার ব্যবস্থা করা। যাক, তবু প্রচেষ্টা জারি থাকল।

 

এক দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতির শেষে ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮-র শীতের সকালে দিল্লী থেকে মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা সাতজন। প্রায় ছয় ঘণ্টা পর মস্কোতে বিমান বদলে দিনের শেষে মুরমানস্কা (Murmansk)।আর শহরে পা রাখতেই এক অন্য উত্তেজনা। উত্তরমেরুর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি! ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে-এর সীমান্তবর্তী এ শহরে তিনদিন কাটিয়ে মেরুজ্যোতির আলোর খেলা (Aurora Borealis) বা নরদান লাইট দেখার সৌভাগ্য হল। তারপর মস্কোতে ফিরে আসা। এখান থেকে ছঘন্টায় আকাশপথে সাইবেরিয়ার ছোট্ট শহর ইরকুটস্ক (Irkutsk) যখন নামলাম ভোরে, তখন তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির অনেক নীচে। অপেক্ষারত রোমানের গাড়ীতে আধঘন্টার মধ্যে শহরের মাঝে হস্টেলের উষ্ণ আশ্রয়ে। ঘনমেঘে ঢাকা চারপাশ, মাঝে মাঝেই বরফ পড়ছে। চারপাশের সবকিছুই বরফে মোড়া। তবু জনজীবন স্বাভাবিক। অ্যানটন কুজমিনের ব্যবস্থাপনায় হবে এই ট্রেকিং প্রোগ্রাম। ভিনদেশে এমন পদযাত্রা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় করার সাহস হল না।

 

আজকের দিনটা এখানেই থাকা। আর সেই সঙ্গে সাইবেরিয়ার এই প্রাচীন শহরটা ঘুরে দেখা। ইংরাজি জানা গাইড মেয়েটির নাম সিনিয়া। রেস্তোরায় হরেক রকমের জানা অজানা খাবার ও শেষপাতে ব্ল্যাককফি। জমা মাছ, সবজি, জামাকাপড়, নিয়ে জমজমাট ফুটপাত। বরফঢাকা পথে বাস, ট্রাম ও অসংখ্য গাড়ি নিঃশব্দে চলেছে। আমরা ঘুরছি সিনিয়া’র পেছনে। প্রায় পাঁচশো বছর পুরনো কয়েকটা কাঠের বাড়ি আছে এখানে।সুন্দরকারুকার্যশোভিতবাড়িগুলোতেলোকজনেরবসবাসআছে।বৈকালহ্রদথেকেবেরনোএকমাত্রনদীআনসায়রেতীরে যখনপৌঁছালাম, তখন তেড়ে তুষারপাত। সাজানো নদীপাড়, মস্কো গেট, জার বীরদের ভাস্করমূর্তিতে চোখ রেখে রেখে ছুটছি। শহরের আধুনিক ঘরবাড়ি, ক্যাথেড্রালগুলিকে দেখে ঢুকে পড়লাম এক ক্যাফেতে। এক উষ্ণ আশ্রয়ে। সুদর্শনা মহিলা দ্বারা পরিচালিত ক্যাফেতে এক কাপ কফির দাম ২৮০ রুবেল। এখানে গাড়ি, বাড়ি, দোকানপাট, হোটেল সর্বত্রই তাপমাত্রা রাখা আছে প্রায় (+)২০ডিগ্রি সে.।আর বাইরে হাড় হিম করা ঠাণ্ডায় তাপমাত্রা (-)১৫ডিগ্রিসে.নীচে। চটজলদি ফিরে এলাম আমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে। কয়েক বস্তা শীতের পোশাক নিয়ে হাজির কুজমিন। নিজেদের মালপত্র ছাড়াও ওদের কাছ থেকে কিছু শীতবস্ত্র সংগ্রহ করলাম।

 

২রা মার্চ শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটল বরফে ঢাকা উঁচু-নিচু পথে। কোথাও কোথাও পিচঢালা পথের দেখা পেলেও অধিকাংশ পথই সাদা। পথের দুপাশে বিস্তীর্ণ তুষারঢাকা প্রান্তর। কোথাও গভীর অরণ্য। মাঝে মাঝে গুচ্ছ গুচ্ছ ঘরবাড়িও দেখা যায়। কাঠের তৈরি এই ঘরবাড়ি গুলোকে দেখে মনে হয় এরা অধিকাংশই নিম্ন মধ্যবিত্ত। প্রিমরস্কি পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে প্রায় ১৩০ কিমি পথ পেরিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জমাটবাধা বৈকাল হ্রদের পশ্চিমতটে জায়গাটির নাম “বলসি কোটি” (Bolshie Koty)।ধারাবাহিকসাদারমধ্যেদিয়েউঁকিমারছেরংচঙেঘরবাড়িওচার্চ।মেঘলাচারপাশ।হ্রদেরউপরটাভালোইজমেছে।কয়েকটাগাড়িওছুটছেএরউপরদিয়ে।বৈকালতীরে বেড়াতে আসা অনেক জনপদের মধ্যে এটিও একটি। তবে লোকজন খুবই কম। জমাট বাধা হ্রদের উপর পা রাখতেই দারুণ উত্তেজনা। শরীরে শীতের পোশাক বাড়িয়ে, জুতোর নীচে কাঁটা লাগিয়ে আর লাদাখের জমাটবাধা সো-মোরিরি উপর চলার অভিজ্ঞতাকে ভর করে শুরু হল হাঁটা। হ্রদের পশ্চিমতট ছুঁয়ে যাবো উত্তরদিকে। তটজুড়ে ছোটবড় বরফের চাঁই জমেছে স্তুপাকারে। এর মধ্যে দিয়ে হাঁটা সম্ভব হলনা। তীর ছুঁয়ে বরফের উপর দিয়ে বাঁদিকে পাহাড় থেকে নালা আকারে নেমে আসা বরফের ঝুরি দেখতে দেখতে চলি মহানন্দে। খানিকটা এগিয়ে জমাটবাধা সমতলে পা রাখতে পারলাম। হ্রদের জল জমেছে নানা কারুকার্য নিয়ে। আলো আঁধারে এদের দেখতে দারুণ লাগে। বাঁদিকে ধারাবাহিক ছোটবড় পাহাড়ের ঢালে ঘন বনানী। পাইন জাতীয় গাছই বেশী। পাহাড়ের ঢালে বরফ জমাট সর্বত্র। প্রথমদিনে হাঁটা ঘন্টা তিনেকের। বিকেলের মিষ্টি আলোয় এক মায়াময় চারপাশ। উঠে এলাম “রোগতকা সুমদো (RogotkaSumdo)। এক ছোট্ট নদী নেমেছে বৈকালের বুকে। জল নেই, সবটাই বরফ। হ্রদের উপর দিয়ে মালপত্র নিয়ে গাড়ি চলে এল এখানে। মালপত্র পৌঁছে দিয়ে কুজমিন ফিরে যায়। আমরা সাতজন, আর দুটি ফরাসী ছেলেমেয়ে। নয়জনের দলের জন্য গাইড, পোর্টার, কুক অর্থাৎ সবকাজকর্মের জন্য একজন লোক।ভিক্টর।হাঁটুবরফেদাপাদাপিকরেতাঁবুটাঙ্গানোরজায়গাকরাহল।একটাবড়তাঁবুতেআমরাসকলে।বেলাপড়তেইবেজায়ঠাণ্ডায়সবাইকাবু।তাপমাত্রা নেমে গেছে (-) ২৫সে’র নীচে। বাইরে আগুন ধরিয়েছে ভিক্টর। পুলকা বা স্লেজে করে বরফের চাঁই বয়ে নিয়ে এলাম আমরাই। দুটো পাত্রে জল গরম হচ্ছে। গরম জল নিয়ে চা বা কফি করতে হবে নিজেদেরকেই। প্যাকেট খাবার গরম করে খাওয়া। রান্নার পাট নেই।  এক কষ্টকর রাত কাটলো।

 

বৈকাল হ্রদ রাঙ্গিয়ে হল সূর্যোদয়। ভোরের মিষ্টি আলোয় খানিকটা উপর থেকে বৈকাল হ্রদকে বেশ দেখতে লাগে। বরফের চাঁই আনো, জল বানাও, গরম জলে খাবার খাও। প্রত্যেকে লেগে পড়লাম পুলকার উপর নিজেদের স্যাক, ও পাঁচ কেজি খাবার রেখে জুত করে বেঁধে নিতে। ভোরের ঠাণ্ডায় বেশ কষ্টকর কাজ। একহাঁটুবরফেপাডুবিয়েনেমে এলাম মসৃণ সমতলে, বৈকালের উপর। স্লেজের দড়ি বাঁধা হয়েছে কোমরের সঙ্গে। জুতোর নীচে কাঁটা থাকায় চলাটা মোটেই কষ্টকর হচ্ছিল না। ধীরে ধীরে স্বচ্ছ নীলাভ কালচে বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনোবল বেড়ে গেল। পাড়ের দিকে নরম বরফ ও বরফের চাঁই এর স্তূপ জমে আছে প্রায় সর্বত্রই। তাই আমাদের চলা অনেকটা ভেতর দিয়ে। বাঁদিকে পাহাড়ের কোলে বনের পাশে দু-চারটে ঘরবাড়ি থাকলেও লোকজনের চলাফেরা নজরে পড়ে না। পূর্বতটে এক অস্পষ্ট পাহাড়ের রেখা দেখা যায়। ৬৩৬ কিমি লম্বা ও ৪৮ থেকে ৭৯ কিমি চওড়া বিশালাকার এই সরোবরের উপর অংশ জমে এক স্বচ্ছ আবরণ। কোথাও সেই আবরণের উপর তুষারপাতের বরফে আর একটা আবরণ তৈরি করেছে। মাঝে মাঝেই দমকা হাওয়া চলে। ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। স্বচ্ছ পিচ্ছিল Black Ice এর উপর দিয়ে স্লেজগুলিকে টানতে কোনও কষ্ট নেই। হাওয়ায় নকসা কাটা নতুন বরফের উপর দিয়ে পুলকা টানাটা সহজ হয়না। সেই স্বচ্ছ তলের নীচে অনন্ত কালো বরফের দিকে তাকালে ভয় হয়। আবার প্রায়শই এরই মাঝে আটকে পড়া ছোটবড় দুধসাদা বুদবুদ বিচিত্র আকার নিয়েছে। Seismic effect-এঅন্তর্নিহিত ফাটল নানা আকারে তৈরি হয়। চোখ বারবার আটকে যায় এই কারুকার্যে।৩১৫০০বর্গকিমি পরিমিত এ বৈকালে শীতকালে চলে আসে দেশ বিদেশের অনেক পর্যটক। নানাভাবে একে দেখা ও অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা। আরামপ্রিয়রা Hobercraft-এ চেপে চলেছেন দুপাশে চোখ রেখে। কদাচিৎদু-একটা সাইকেল ও মোটর বাইকও দেখা যায়। এদের চাকাগুলি বিশেষভাবে তৈরী। স্কেটিং করে দ্রুত চলেছেন দুজন। আমাদের মত পদযাত্রীর দেখামেলেনা। আকাশে হালকা মেঘ, মৃদুমন্দ হাওয়া। গতরাতে বেজায় ঠাণ্ডায় কাবু হলেও আজকের রোদ ঝলমলে  দিনটা বেশ আরামের। লেকের সর্বোচ্চ গভীরতা ৫৩১৫ ফুট তটভূমির উচ্চতা মাত্র ১৫০০ ফুট। সরোবরটি সরাসরি অতিক্রম করা যায়। সেক্ষেত্রে তাঁবু টাঙ্গানো হবে হ্রদের উপরেই। দুপুর হতেই ভিক্টরের নির্দেশে বরফের উপর গোল হয়ে বসে পড়লাম। ফ্লাক্সে আনা গরম জলে চা ও সঙ্গে নানা ধরনের বিস্কুট, চিস, ক্রিম আর রকমারি সসেস।

 

চলে এসেছিলাম হ্রদের অনেকটা ভিতরে। বিরতির পর পাড়ের দিকে বাঁক নিয়ে চলা। চোখ রাখি পাহাড়ের কোলে ঘরবাড়ির সন্ধানে। বেলা পড়ে আসতেই গোটা তিনেক বাড়ি দেখতে পেয়ে ওদিকেই চলা। দুটি বাড়িতে গুটিকয়েক লোকজন থাকে। ছোট্ট গ্রামটির নাম হমুতি বিগ (Homuty big)।একটি বাড়ি ফাঁকা পাওয়া গেল। ভেতরে মাচা করা আছে। অন্ধকার নেমে আসতেই বেশ ঠাণ্ডা প্রায় (-) ২৮ ডিগ্রী সে.। উনুনে আগুন জ্বলল। গরম চা ও স্যুপ পেয়ে সকলে চাঙ্গা হয়। ছোট্ট থলিতে চাল দিয়ে গরম জলে ডুবিয়ে ভাত রান্না। সঙ্গে গরম করা হল প্যাকেট মাংস। সস ও সসেস-তো আছেই। তারপর গরম ঘরে সকলেই সুখনিদ্রায়।

 

সুন্দর সূর্যোদয়ের আশায় শীতবস্ত্রের স্তর বাড়িয়ে চলে এলাম সাগরসম সরোবরের তীরে। পূর্বতটে অস্পষ্ট পাহাড়ের পেছন থেকে হবে সূর্যোদয়। খানিকটা মেঘের আস্তরণ থাকলেও আকাশ, মেঘ ও সর্বোপরি নানা আকারের বরফের স্তূপ ও মসৃণ তলকে বাদদিয়ে সূর্য উঠলো। দেখা আর ছবি তোলার বিরাম নেই।

 

রাতে মাংস, সকালে মাংস আবার দুপুরেও তাই। গরু, শুয়োর আবার কখনও মুরগী।এখানে তটভূমি লাগোয়া সরোবরের অংশ বড্ড এবড়ো-খেবড়ো। বরফের চাঁইয়ে পরিপূর্ণ। এই অংশটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়া বেশ কষ্টকর। যেমন সাগরপাড় থেকে গভীরে প্রবেশের প্রথমটা হয়। একবার ভেতরে ঢুকে পড়তেই সব ঠিকঠাক। স্বচ্ছ মসৃণ জলভূমির নীচে নানা আকারের বরফের চাঁই আটকে আছে। কোথাও গোলাকার, আবার কোথাও বরফি আকারের। এ যেন নানা আকারের মোজায়েক করা। অনেকটা দূর থেকেই হ্রদের মাঝে একটা ছোট্ট পাহাড়কে দেখা যায়। একে লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে চলি। কালচে নীলাভ প্রান্তরে সাপের মত একেবেকে একটা সাদা রেখা। এগুলি ছোটবড় ফাটল। ফাটলের মুখে নতুন বরফ জমে এক একটা সুন্দর আঁকাবাঁকা রেখা তৈরি করেছে। তুষারপাতের বরফের উপর হাওয়ার দাপটে তৈরি হয়েছে সুন্দর কারুকার্য যেমনটি আমরা দেখি সাগরপাড়ে বা মরুভূমিতে। হ্রদের মাঝে এই ছোট্ট পাহাড়টির নাম করমোরণে রক। এরই পাশে হাওয়ার আড়ালে আমাদের দুপুরের বিরতি। বছরের অন্য সময় এই পাহাড়ের কোটরে পাখিরা বাসা বাঁধে। পাহাড়টির চারপাশে বরফের ঝুড়ি নেমেছে। ভারি ভালো লাগে। এই সরোবরে এমন ছোটবড় দ্বীপের সংখ্যা কম নয়। হাঁটা শুরু হল সুন্দর সমতলে কাঁটা লাগানো জুতোয় মচর মচর শব্দ শুনতে শুনতে। সামনের পাহাড়টা ডানদিকে বাঁক নিয়েছে আর ওখানেই ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা ঘরবাড়ি দেখা গেলেও এখনো অনেকটা দূরে। আরো গভীরে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে Hobercraft ছুটছে পর্যটক নিয়ে। বাঁদিকে তীর ঘেসে বড় বড় বরফের চাঁই-এর এক উঁচু প্রাচীর যেন একটা লম্বা বাঁধ তৈরি করেছে।

 

তাপমাত্রার তারতম্য হলেই বরফের স্তর বাড়তে থাকে। তখন স্তর ধাক্কা খায় প্রবল চাপে স্তরের ভাঙা চাঁই একটার উপর উঠে পড়ে আর একটা। এমনই প্রাচীর ভেদ করে পাড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সরাসরি ঘরগুলির কাছে পৌঁছে তুষারপাতের জমা একহাঁটু বরফ ভেঙে ওঠাটা সহজ হল না। এর মধ্যে পুলকাকে তুলতেই সকলে হিমসিম। ভিক্টরের পিছু পিছু একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। এটি Doctor’s Hut।এক সময় ছোট্ট একটা Health Centre ছিল।ডাক্তার বাবু বেঁচে নেই।এখন আর কেউ থাকেনা। সেনায়াপ্লেস (Senaya place) এর এই নির্জনে এবাড়ি আমাদের এক আরাম-দায়ক আশ্রয়।বরফ ঘেঁটে বাড়ির চারপাশে চলার অসুবিধা হলনা।অন্ধকার নেমে আসতেই তাপমাত্রা (-) ২০ডিগ্রী সে. এর কাছাকাছি।ঘরের ভেতরটা আরামদায়ক হলেও ঘরের বাইরে বেরনোটা বেশ কষ্টকর। তবুও বিশালাকার জমাটবাধা বৈকাল হ্রদ ছুঁয়ে এক আকাশ তাঁরাদের দেখতে বাইরে বেরতেই হল।

 

সকালে জনমানবহীন ছোট্টগ্রাম থেকে নেমে এলাম সরোবরের উপরে। নরম তুষারের উপর দিয়ে দিয়ে  Black Ice–এ পা রাখতেহল অনেকটা চলার পর। নিচের দিকে তাকালে শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার। চিরখাওয়া সাদা ফাটলের গভীরতা দেখে বুঝতে পারি জমে যাওয়া ঘনহিম বরফের আস্তরণটি বেশ পুরু। বরফের নীচে আছে ছোট বড় বহু মাছ। সর্বোচ্চ গভীরতা ৫৩১৫ফুট ভাবতেই বিস্ময়।আর এমন গভীর সরোবরের উপর দিয়ে আমরা হাঁটছি। সাইবেরিয়ার এই সরোবরে অন্যসময় প্রচুর পাখি থাকে।বনে Rain deer সহ আছে বহু জন্তুজানোয়ার।গরমের মরসুমে এর নীলাভ জলে ভেসে বেড়াতে পৃথিবীর নানাপ্রান্তের মানুষেরা ভিড় জমায়। সরোবরের পাড়ের ঘরবাড়ি ও হোটেলগুলি তখন জমজমাট।বেশ চলছিলাম অনেকটা গভীরে, মহানন্দে। যেতে হবে পাড়ে। ওখানে পাহাড়ের গায়ে পাথুরে হাতি।হ্যাঁ, প্রাকৃতিক ভাবে এই পাথুরে হাতিটি শুড় ঠেকিয়েছে সরোবরে। এখানেই হাওয়ার আড়ালে এক পাথুরে কোঠরে জিরিয়েনেওয়া আর গরমচায়ের সাথে দুপুরে একই ধরনের খাবার।বেলা তিনটে বাজতেই নজর রাখি পাহাড়ের ঢালে বনানী মাঝে ঘরবাড়ির খোঁজে। ঘন বনের মাঝে অনেকটা উপরে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে ওদিকেই পা বাড়ালাম। অনেক কসরতের পর এক বন নরম বরফের মধ্য দিয়ে বাড়িটির কাছে পৌঁছানো সহজ হলনা। লোকজনের দেখা নেই। দরজা খোলা, ভেতরে আগুন জ্বালাও, বাইরে বিছনায় রাত কাটাও, আসবাবপত্র, টুকটাক খাবার যেমন আছে ঠিক তেমনি রেখে চলে এসো। ভিক্টর জানায় এই জায়গাটির নাম ডিরোভতায়া প্লেস (Dyrovtaya Place)।ভাড়া বা অনুমতি কোনটাই দরকার নেই।অনেকটা উঁচু থেকে বৃষ্টি যায় সরোবরের অস্পষ্ট ও পারে। রাতের বেজায় ঠাণ্ডা বলে দেয় আকাশ পরিষ্কার। ফরাসী ছেলেমেয়ে দুটি ও এখন বুড়োদের দলেএকই পরিবারের।

সকালের এক অসাধারণ সূর্যোদয়। সূর্যের আত্ম প্রকাশের আগেই আকাশ ও ঢেউখেলানো সরোবর কাঁচা হলুদ রঙ মেখে নিল।ক্ষণে ক্ষণে এর রঙ বদলায়। বিদ্যুতের উচ্চস্বরে সূর্যবন্দনা অন্য এক পরিবেশ তৈরি করে। সকলেই পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা।ভিক্টর জলগরম করে নিজের খাওয়ায় ব্যস্ত। নির্দেশ কোথাও কোন নোংরাকরা চলবেনা। একটাকাপও একটা বাটি এই আমাদের বরাদ্দ।কত কম জিনিসপত্রে ট্রেক করা যায় এখানে নাএলে বুঝতে পারতামনা। বেজায় ঠাণ্ডায় পুলকাবাঁধা, নামিয়েআনা সরোবরের উপরে, এবড়ো খেবড়ো বরফের চাঁইয়ের মধ্যে দিয়ে মসৃণ সমতলে।ভিক্টরের পিছু পিছু ছলেছি অনেকটা গভীরে।আজই হবে বৈকালের তটে শেষ রাত্রিবাস।থাকার ব্যবস্থা লগহাউসে।হাঁটতে হবে প্রায় ২কিমি।এগিয়ে ও পিছিয়ে পড়া সঙ্গীদের ছোট ছোট বিন্দু মনে হয় এই বিস্তীর্ণতার মাঝে। বাঁদিকে পাহাড় উত্তরপূর্ব দিকে বাঁক নেয়। দুপুরের পর আকাশে লম্বা আকারের মেঘ দেখা দেয়। বেশ ভালো লাগে। এখানে তুষার-পাতের বরফই বেশী, তাই চলার গতি কমে। ক্রমে হাওয়ার দাপট বাড়তে থাকে। বরফ উড়তে থাকে। ভিক্টরের নির্দেশে পাড়ের দিকে এগোতে থাকি। এক জায়গায় গোল হয়ে বসে এই হাওয়ার মধ্যে দুপুরের খাওয়া তিনবেলার মাংস খেতে খেতে মুরগিতে বড্ড অরুচি। বিফ সসেসের চাহিদাই বেশী।

হাঁটা শুরু করতে উত্তর দিক থেকে ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে। বাঁদিকের পাহাড়গুলি বেশ উঁচু এবং অনেকটাই দূরে। দ্রুত হেঁটেও কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। বরফের কুচি সারা শরীরে ভরে যায়। মুহূর্তের মধ্যে সহজ সুন্দর প্রকৃতি যেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। দমকা হাওয়ায় বরফ উড়তে থাকে। তখন চারপাশটা কিছু দেখা যায়না। ভিক্টরকাছেআসেআরবলে,Danger।ও ফোনে কারো সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। যোগাযোগ হয়েছে। হাত কামানের মত একটা অস্ত্র দিয়ে আকাশের দিকে ফায়ার করে নিজেদের অবস্থান বোঝাল। কোন উদ্ধারকারী দলকে ডাকছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে চারপাশের প্রকৃতি বদলে গেল। আমরা এক জায়গায় জড় হলাম। আধঘন্টার মধ্যে বরফের উপর দিয়ে একটা শক্তপোক্ত গাড়ি ও এক উদ্ধারকারী দল হাজির। চটপট আমাদেরকে গাড়ির মধ্যে গুজে দিল আর স্লেজের দড়ি বাঁধা রইলো গাড়ির সঙ্গে। আমরা পাড়ে এলাম। অল্প সময়ের মধ্যে গোলাস্তলায়া (Goloustaya) লগ হাউসের আরামের আশ্রয়। পাঁচ দিনের হাঁটা এখানেই শেষ হল। ঘরের মধ্যে তাপমাত্রা তখন প্রায় (+) ২০ ডিগ্রী সে.। শেষ ঘন্টাদুয়েক আর হাঁটা হল না। লগ হাউসটা সরোবর তীরে। কিন্তু দূরে পাহাড়ের ঢালে বরফের মাঝে আছে ঘরবাড়ি ও হোটেল। নিঃসঙ্গ এই বাড়িটি দারুণ। বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ আর ভিতরে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরে আনন্দের জোয়ার। ভিক্টরের ঝোলা থেকে ক্যাম্প ফায়ারের জন্য বেরিয়ে পড়েছে কয়েক বোতল ভদ্‌কা।

সকালে চারিদিকে প্রশান্তি। হালকা মেঘের আবরণ ও জমাটবাঁধা ঢেউ খেলানো হ্রদ সিঁদুর রঙে রাঙানো। আমাদের অপেক্ষা রোমানের জন্য। রোমানের গাড়িখানা বরফে ঢাকা ওঠানামা পথে পাহাড়িয়া জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পৌঁছালাম ইরকুটক্স (Irkutsk)।ইরকুটক্স থেকেTrans-Saiberian Train –এ সেদিনই রাতে রওনা হলাম মস্কোর দিকে। সে এক অন্য ভালো লাগার বেড়ানো।

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!