মিশন মুলকিলা : সৌম্যদীপ মন্ডল

মিশন মুলকিলা : সৌম্যদীপ মন্ডল
মিশন মুলকিলা : সৌম্যদীপ মন্ডল

সোনারপুর আরোহী আগামীর অভিযাত্রীদের প্রতি সবিশেষ যত্নবান। ওরা জায়মান এক ঝাঁক আরোহীদের নিয়ে সংগঠিত করেছিল লাহুল-লাদাখের মাঝ এলাকায় অবস্থিত মিলাং পর্বতমালার M-4, বা মুলকিলা শিখরে এক জমজমাট পরীক্ষামূলক অভিযান। ওই দলের কয়েকজনের, মানে যাদের কাচ্ছে এটিই ছিল প্রথম অ্যাডভেঞ্চার কর্ম, তাদেরই একজন সৌম্যদীপ মন্ডল। প্রথম অভিযানের পরে সে প্রথম গল্প বলার কাজটিও বেশ পরিপাটি সেরে ফেলেছে।

ক্র্যাম্পনের মচ মচ শব্দে অদ্ভুত রোমাঞ্চ, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ব্যাপক ফুটি ফাটা হিমবাহের মধ্য দিয়ে ক্রিভাস টপকাতে টপকাতে ধীর গতিতে এগিয়ে চলা। তারপরেই মন মাতানো ধূ ধূ তুষারক্ষেত্র। পুরোটাই জীবন বিজ্ঞান বইয়ে পড়া আপদকালীন হরমোন অ্যাড্রিনালিনের খেলা।

না, গল্পটা শুরু করাই যাক। ২০১৮, সোনারপুর আরোহীর পর্বতাভিযান। মাউন্ট মুলকিলা (রুপলী দেবী)। ১৯৩৯ এর সেপ্টেম্বরে একটি অ্যাংলো-অস্ট্রিয়ান গ্রুপ মিলাং রেঞ্জ (M-Range) এ প্রথম সফল অভিযান চালায়। মিলাং রেঞ্জের মোট দশটা পর্বতকে তাঁরা ইংরাজি ‘M’ অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করেন। মুলকিলা (Milang-4 বা M-4) হল এই রেঞ্জের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। উচ্চতা 6517 মিটার। কড়া প্র্যাক্‌টিস, শারীরিক ও মানসিক শক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নতুন-পুরনো মিলিয়ে তৈরি হয়ে যায় আমাদের ১০ জনের টিম। আরও চার-জনের মতো এটাই ছিল আমার প্রথম অভিযান। রক্ত চনমন করছে সবার, সে যেন দুর্গাপূজার থেকেও বেশী তোড়জোড়। শ্রদ্ধেয় দীপঙ্করদা’র (ঘোষ) বাড়িতে বসে ওনার কিছু ছবি ও শুভকামনা নিয়ে লক্ষ্য স্থির করলাম। ম্যাপ স্টাডি, লোড প্যাকিং, ইকুইপ্‌মেন্ট চেকিং, সামিট প্যাক, ডেলি প্যাক গোছানো – সব মিলিয়ে সে এক বিশাল উৎসব-কর্ম।

সব সেরে ৮ জুলাই সকালে সঞ্জয়দা’র (সঞ্জয় চক্রবর্তী) সাথে রওনা দিলাম দিল্লির উদ্দেশ্যে। বাকি মেম্বাররা ওইদিন রাতের কালকা মেল ধরলো। পরদিন IMF থেকে Equipment তুলে ও Insurance এর কাগজপত্র জমা দিয়ে ফিরলাম ওল্ড দিল্লি। এবার বাকি টিমের এসে পৌঁছনোর অপেক্ষা। কালকা-মেল’এ টিম এলো রাত ১১ টায়। আমরাও উঠে পড়লাম। পরের দিন সকালে ৫.৩০ মিনিটে এক গাদা ডাফেল ব্যাগ সঙ্গে করে আমরা নামলাম চণ্ডীগড় ষ্টেশনে। গাড়ীতে মালপত্র তুলে মানালির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় মন ভরানো সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁসে ছড়ানো রোদ উপভোগ করতে করতে সোজা মানালির শিবালিক হোটেলে পৌঁছলাম।

এবার শেষ মহড়ার প্রস্তুতি। উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে একবার হিড়িম্বা মন্দির ঘুরে আসা। পরদিন সবজি বাজার, মুদি বাজার সব শেষ করে অপেক্ষা শুভযাত্রার। ১২ জুলাই সকালে পার্থদা’র হাঁকডাকে কাকভোরে সবাই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রোটাং পাস টপকে দারচা, তারপরই  পৌছালাম আমাদের অভিযানের প্রান্তিক গ্রাম ইয়োচে তে।

ডানদিকে ছবির মত ঝোলানো ব্রিজ পেরোলেই পাহাড়ের ঢালে ক্রমবর্দ্ধিষ্ণু এই গ্রাম। এখান থেকেই মূলত অভিযান শুরু। পোর্টার বন্ধুদের মালপত্রের ওজন বুঝিয়ে দিয়ে যে যার স্যাক পিঠে তুলে নিলাম। ডান হাতে মিলাং নালা কে রেখে একটি সংকীর্ণ ট্রেল দিয়ে এগিয়ে চলা। যথেষ্ট ভয়ঙ্কর রাস্তা, ডান দিকে নীচ দিয়ে সশব্দে মিলাং নালা বয়ে চলেছে আর বামদিকে খাড়াই ভাঙাচোরা আলগা পাথর ও কাঁকড়ের দেওয়াল। এরই মধ্য দিয়ে অতি সন্তর্পনে এগোনো। একটা ছোট্ট ভুলে যে কোন মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে অভিযানটা। ভয়ঙ্কর রাস্তাটি পেরোনোর ঠিক পরেই মনমুগ্ধকর সবুজ উপত্যকা। উপত্যকার রূপ রস গন্ধ নিতে নিতে পৌছালাম ক্যাম্পের জায়গাটাতে। বামদিক দিয়ে KR* নালা এসে মিশছে মিলাং নালার সঙ্গে। KR নালার ধারেই টেন্ট পিচ করা হল। এখানেই আমাদের প্রথম খোলা আকাশে রাত্রিবাস।

পরদিন সকালটা ছিল বৃষ্টি ভেজা। এরই মধ্যে সবাই ব্রেকফাস্ট সেরে ক্যাম্প গুটিয়ে রেডি। এবার স্বমহিমায় প্রবাহিত সেই KR নালা টপকানোর পালা। সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে জলের উচ্চতা। প্রায় ঘণ্টা আড়াই এর যুদ্ধে অর্ধেক শরীর অসাড় করে সবাই নালাটি পেরিয়ে গেলাম। সামনে মিলাং নালা। এই দুই নালার মাঝের উপত্যকা দিয়ে আমাদের পথ। অল্পবিস্তর বোল্ডার অঞ্চল পেরিয়ে বাকিটা মায়াভরা সমতল। এভাবেই মিলাং নালাকে ডান দিকে রেখে ঘণ্টা দুয়েক চলার পর বামদিক দিয়ে আসা মুলকিলা নালার সঙ্গে দেখা, সে এসে মিলাং-এর সাথে মিশেছে। এই সংযোগ স্থলে একটি কংক্রিটের ঘর দাঁড়িয়ে। ঘরটির মধ্যে গোবর এবং তার গন্ধ। যাই হোক, এটাই আমাদের ট্রানসিট ক্যাম্প-২। এদিন আমি আর সঞ্জয়দা চলে যাই পোর্টার-দের সঙ্গে কিছুটা লোড এগিয়ে রেখে আসতে। বেসক্যাম্প এর বেশ কিছুটা আগেই মালপত্র রেখে টেন্ট চাপা দিয়ে ফিরে আসি।

পর দিন ঝকঝকে সূর্যদেবকে মাথায় নিয়ে আমরা আমাদের বেসক্যাম্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম মূলকিলা নালাকে ডানদিকে রেখে। অদূরেই মুলকিলা স্নাউট। তার বাম দেওয়ালের বিশ্রী স্ক্রি-জোনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা। এভাবেই একে একে সন্তর্পণে মুলকিলা গ্লেসিয়ারের উপর উঠে আসি। এই প্রথম তাকে চোখ ভরে দেখা। ধপধপে সাদা সাজে স্বমহিমায় সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অভীষ্ট শৃঙ্গ মুলকিলা। সামনেই তার প্রহরী পর্বত “দ্য স্পাইক” (M-5); নামই যথেষ্ট বর্ণনার দরকার নেই। এবার লক্ষ স্থির রেখে এগিয়ে চলা, বিশাল দূর-বিস্তৃত হিমবাহ, যার আছে পাঁচটি মোরেন এলাকা। আমরা লেফট ল্যাটেরাল মোরেন ধরে কখনো হেঁটে কখনো লাফিয়ে এগোতে থাকলাম। দেখা যাচ্ছে বাম দিকে মূলকিলার উত্তর–পশ্চিম গা থেকে একটা হিমবাহ এসে মূল হিমবাহে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের ক্যাম্প ১ ঐ মূল হিমবাহের পথে। ডান দিকে বিশাল একটা ঝুলন্ত হিমবাহের উপর খাড়া দাঁড়িয়ে মিলাং-১০ ( M-10)। শেরপারা কিছুটা আগেই পৌঁছে মিলাং-১০ এর ঠিক নিচে আমাদের বেস ক্যাম্প বানিয়েছে। আরো কিছুটা চড়াই উৎরাই ভাঙতে ভাঙতে আমরা বেসক্যাম্পে (৪৮০০ মি) পৌছলাম। তখন সূর্য প্রায় পশ্চিম আকাশে।

১৫ জুলাই এক নতুন সকালের শুরু বেসক্যাম্পে। সাজো সাজো রব চারিদিকে, আজ আমাদের বেসক্যাম্প পূজা। একাধারে চলছে সুজি আর লুচি ভাজার প্রস্তুতি, অন্যদিকে মন্দির তৈরি। তা, পূজা শেষ হল। এর পর চলল ফটো সেশান এবং ইক্যুইপ্‌মেন্ট রেডি করার পালা। ঐ দিনটা সারাদিন বিস্তর হাসি, মজা, রান্না ও খাওয়া দাওয়া করে কাটিয়ে দিলাম। এরই মধ্যে পরবর্তী দিনগুলির প্ল্যান রেডি। পরের তিনটে দিন কাম্প-১ এ লোড ফেরি। ঘুম ভাঙতেই সকাল ৮ টায় সবাই রেডি হয়ে গিলা-ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ি লোড ফেরি করতে। স্নো-বুট, ক্রাম্পন পরে মচ মচ শব্দে এগিয়ে চলা। ক্রিভাসের  ছড়াছড়ি, ফুটিফাটা হিমবাহ। দক্ষিনে ঐ পথ ধরে বেশ কিছুটা এগোনর পর একটা বিশাল আকৃতির আইসফল জোন পথ আটকায়।  প্রায় ২-৩ তলা বাড়ির সমান ভাঙাচোরা বরফের দেওয়াল। এটার বামদিকে একটা প্রায় ৮০ ডিগ্রি’র প্যাচপ্যাচে কাদা ভরা জল নামার পথ ধরে একে একে উপরে উঠে এলাম খুব সন্তর্পণে। সারাক্ষন পাথর ঝরেই চলেছে। এবার খাড়াই আলগা পাথরের দেওয়াল, তার ওপর নরম বরফের চাদর। আর নরম বরফের কোলেই লুকিয়ে আছে মৃত্যুর হাতছানি। এখানে সব ক্রিভাসগুলো ঢেকে আছে ঐ নরম বরফের আস্তরণে। এছাড়া বামদিকের দেওয়াল থেকে পাথর পতনের ভয় নিয়েই দ্রুত নিঃশ্বাসে এগোতে হচ্ছে। সামান্য অসতর্কতাই সব শেষ করে দিতে পারে যে কোন সময়। তার কিছুটা পরেই বিশাল আইস-ফিল্ড। তার বাম দিক ধরে জিগজ্যাগ করে এগিয়ে চলা। প্রায় ৭ ঘণ্টা হাঁটার পর পেলাম দীপঙ্কর স্যারের বর্ণিত সেই জায়গা, বামদিকে বিশাল একটা ক্যাপ গ্লেসিয়ার তার ফুটিফাটা চেহারা নিয়ে ঝুলে আছে আর ডানদিকে ক্যাম্প করার বিস্তর জায়গা। চোখের সামনে বাম থেকে ডাইনে একে একে স্বমহিমায় খাড়া M-1, M-2, M-6 ( তারাগিরি ), M-7, M-8, M-9, M-10, আর একটু উঠতেই M-2 ও M-6 এর মাঝখান দিয়ে দেখতে পেলাম আমাদের শৃঙ্গ মুলকিলা ও তার একনিষ্ঠ প্রহরী “দ্যা-স্পাইক”। এখানেই আমাদের কাম্প-১ (৫২৫০ মি)। এভাবেই চলল পরবর্তী দুই দিনের লোড-ফেরি।

এবার ক্যাম্প-১ থেকে লক্ষ্য স্থির করে বেরিয়ে পড়ার পালা। একদিন আমি এবং পার্থদা শেরপাদের সঙ্গে উপরের ক্যাম্পের রাস্তায় রেকি করে এলাম। এবার ক্যাম্প-১ ছেড়ে সামিট ক্যাম্প এর উদ্দেশ্যে রওনা দেব। এখন আমরা দলে চারজন। দলনেতা বিপ্লব বৈদ্য, রুদ্র প্রসাদ হালদার, পার্থ সারথি লায়েক ও সর্ব কনিষ্ঠ আমি। আর আমার মাথায় তখন একটাই জিনিস চক্কর কাটছে যে, যাইহোক না হোক ঐ তিনজন ২০-২২ বছর ধরে পাহাড়ে আসছে। ওরা কি করে ? কীভাবে সুস্থ থাকে এত উপরে? সেই কৌশল শিখতেই হবে। যাইহোক, হাঁটা শুরু হতেই দুই তিন পা অন্তর ক্রিভাস। হিমবাহের সে এক ভয়ঙ্কর রূপ। কোথাও নরম বরফের চাদরে শৌখিন ভাবে ঢাকা এই মৃত্যু-গহ্বর। আমরা এদিক ওদিক করে ক্রিভাস এড়িয়ে চলতে লাগলাম। সামনেই একটি হাই পয়েন্ট, এটিকে ডানদিকে রেখে এগোতে লাগলাম। এবার সফট স্নো ফিল্ড, নরম বরফে বেশ পা ঢুকছে। যেতে যেতে পৌঁছলাম দ্বিতীয় আইসফলের গোড়ায়। সূর্য তখন মধ্য গগনে, সফট স্নো-ফিল্ড ক্রমে আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে। হঠাৎ বিপ্লবদা চলতে চলতেই কোমর পর্যন্ত ঢুকে গেলেন।  ওনাকে সবাই মিলে টেনে হিঁচড়ে বার করা হল। ওঁর স্যাকটি পিঠে নিয়ে তিন চার পা পেরোতেই এবার আমি ঢুকলাম, একদম কোমর অব্দি। নড়াচড়া করতে পারছিনা, বাইরে থেকে টানলে মনে হচ্ছিল শরীর দু-খণ্ড হয়ে বেরোবে। যাই হোক, পার্থদা ও শেরপাবন্ধুর বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় বেরোলাম। এবার একটা দড়িতেই রোপ-আপ হয়ে ধীর গতিতে দ্বিতীয় আইসফল জোনে প্রবেশ করলাম। কি অপরূপ বরফের কারুকার্য। সারাদিনের ক্লান্তি ভোলানোর জন্য যথেষ্ট। আইসফল জোনের মধ্যেই একটা সুন্দর আইস-ফিল্ড। এখানেও ক্যাম্প করা সম্ভব। আমাদের ক্যাম্প অবশ্য আরও উপরে। হঠাৎ আবহাওয়া বিগড়ে গেল। তারই মধ্য দিয়ে অতি সন্তর্পণে সেলফ অ্যাঙ্কর চেঞ্জ করতে করতে এগিয়ে চলা, এভাবেই পৌঁছলাম ক্যাম্প-২ অর্থাৎ সামিট ক্যাম্প(৫৮২০ মি)। এই জায়গাটা অনেকটা ক্যূম অর্থাৎ বাটির মত। হাওয়া এখানে বেশ কম চলে। প্রায় ১১ ঘণ্টার মার্চের ক্লান্তির দূর করতে গরম কফি বানিয়ে টেন্টে ঢুকলাম। এবার স্নো ফল শুরু। আবহাওয়ার রিপোর্ট নিয়ে যা বোঝা গেল আগামী ৫-৬ দিন আবহাওয়া খারাপ। কাল দিনটা (২৩ জুলাই) একটু  ভালো, তাই সিদ্ধান্ত হল কাল রাতেই সামিট পুশ্‌। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলাম না।

একটু দেরীতেই ঘুম থেকে উঠলাম। কফি কাপ টা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পুরো “থ”! একেবারে চোখের সামনে উন্মুক্ত রুপালী দেবী। সূর্যের রশ্মি কালো পাথর আর বরফে চকচক করছে। বামদিকের রিজটা সোজা M-5 এ যুক্ত হয়েছে। ডানদিকের হাই পয়েন্টের গা ধরে চলছে ক্রমাগত রকফল। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল কলকাতার দিপাবলী চলছে। যাইহোক এভাবেই চারজন এক টেন্টে কখনো ডাল কখনো স্যুপ খেয়ে অভীষ্ট সময়ের প্রহর গুনছি। সন্ধ্যে থেকে রেস্ট। ২৩ জুলাই রাত ১২ টা ১৫ মিনিটে সবাই রেডি হয়ে এগোলাম। ১১-৩০ থেকে অল্প অল্প স্নো ফল হচ্ছে, তারই মধ্যে হেড টর্চের আলোয় এক লাইনে এগোতে থাকলাম। হঠাৎ আমার শারীরিক অবনতি। দলের সিদ্ধান্ত ও নিজের ভালোর কথা ভেবে একজন শেরপাকে নিয়ে আমি তাঁবুতে ফিরি।  কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। সকাল হতেই টেন্টের গেট খুলে বায়নাকুলার নিয়ে বসে যাই। ওরা তখন প্রায় ৭০-৭৫ ডিগ্রীর ওয়ালটা ক্লাইম্ব করছে। দুজন উপরে একজন ওয়ালে। কি লড়াইটাই না লড়ছে! এ সমতলে বসে টের পাওয়া সম্ভব নয়। এবার ওনাদের সামনে অগনিত জেনডারম। ভয়ঙ্কর রাস্তা। তার ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। দুপুর একটার সময় চতুর্থ জেনডারমটা পেরোচ্ছে। আমি বায়নাকুলার সরাচ্ছিনা। হঠাৎ আবহাওয়া চরম অবনতির জন্য সব পণ্ড। এখন চারটে পনেরো আবার দেখা যাচ্ছে। দেখলাম ওরা নামছে। এক দুই করে গুনে দেখলাম সবাই নামছে। তখনও সামিটের খবর জানিনা কিন্তু আনন্দে আপ্লুত, সবাই ফিরছে।

তারও অনেকক্ষণ পর পার্থদা ঘাড় নাড়িয়ে জানাল আমরা অসফল। কিন্তু এতে অসফলতার কষ্ট নামমাত্রও ছিলনা। কারণ, আমরা যে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছিলাম, বা মুলকিলা আমাদের হাতে যে উপহার তুলে দিয়েছিল তা শত সফলতারও অধিক। একে একে সবাই ফিরলো। পরে সবার সঙ্গে কথা বলে জানলাম একেবারে চূড়ান্ত পর্বে সব দৃশ্য আড়াল করা ভারি হোয়াইট আউট ওদেরকে আর এগোতে দেয়নি। একান্ত বাধ্য হয়েই ৬৩৬৩ মিটারে জাতীয় পতাকা ও স্যাটেলাইট ট্র্যাকার (ডেলর্মে) সমেত ছবি তুলে ফিরে আসে। পরদিন সামিট ক্যাম্প থেকে চেনা বিপদগুলিকে দেখতে দেখতে সটান বেসক্যাম্প নামলাম। বেশ সন্ধ্যে হয়ে গেছিল কিন্তু ওয়াকিতে খবর ছিল আজ দারুন মেনু। অগত্যা নামতেই হ’ল। নইলে পেট বাবাজি ক্ষমা করত না যে!

ফিরে এসে দিনের পর দিন চলে যায়। আস্তে আস্তে অনেক কিছু ফিকে হয়ে আসে। কিন্তু মুলকিলা ম্লান হয় না এতটুকু। বেশ বুঝি, যাই ঘটুক না কেন, প্রথম অভিযানের স্মৃতি কিছুতেই মুছে যাওয়ার নয়।

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!