মোমোর ঝাল : রুদ্রপ্রসাদ হালদার

মোমোর ঝাল: রুদ্রপ্রসাদ হালদার
মোমোর ঝাল: রুদ্রপ্রসাদ হালদার

হুজুগের চাপে উইক-এন্ড ট্যূরে এখানে ওখানে গিয়ে মজলিশি করে ফিরে আসা যায়, তেমন জোর হুজুগ চাপলে জঙ্গলে পাহাড়ে এক-দুই-তিন সপ্তাহ হারিয়ে যাওয়াও চলে। কিন্তু, হুজুগ কি পর্বতের শিরেও চড়িয়ে দেয়? হ্যাঁ, তাও বুঝি দেয়। হেন অবিশ্বাস্য কাণ্ডও ঘটে, যেমন ঘটেছিল রুদ্রদের আরোহণের বোধন পর্বে, একদশক আগে। আজ যে এভারেস্ট কাঞ্চনজঙ্ঘায় সফল অভিযান করে ফিরেছে তার মধ্যে একআজব ক্ষ্যাপামির বীজ বপন হয়েছিল সেই শুরুর দিন-গুলোতে। গল্প বলছে, রুদ্র নিজে, রুদ্রপ্রসাদ হালদার।

কুয়াশা তখনও যাচ্ছি যাবো করে অলস অভ্যেসে ঝাপসা করে রেখেছে মানালিকে। বেলা বারোটা। আধোঘুমের মধ্যে ভেসে আসছে শেষ বর্ষার ভরা যৌবনে মাতাল বিয়াসের অবিশ্রান্ত তর্জন, কখনও বা বাস-গুমটির দিক থেকে কিছু যান্ত্রিক বাহনের কর্কশ প্রতিবাদ।

 

সেই সময় হোটেলের ঘরে ঘুম ভেঙেছে সাত আরোহীর।গৌতম আর রুপেন বেরিয়ে গেছে কলকাতা ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করতে।বাকি সবাই হাত মুখ ধুয়ে, প্রাতঃকৃত্য সেরে এসে একে একে বসেছি বাস স্ট্যান্ডের পেছনে, অতি পরিচিত ‘মোমো সেন্টার’ এর দোতলায়। দোতলায় দশ ফুট বাই দশ ফুটের পুরোটাই আমাদের দখলে। প্রথমে হাতে গরমা-গরম চা, দু-একজনের হাতে জলন্ত সিগারেট। রেস্তোরাঁর রসুইঘর থেকে ধোঁয়ার সাথে আসা প্রাণকাড়া মোমোর সুবাস। সোলো(সুব্রতদাকে আমরা এই নামেই ডাকি) জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মোমো সেন্টারের মালকিন নেপালি মহিলার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে আওয়াজ দিল, বইনি, জেরা তিখা করকে বানানা।

স্বভাবরসিকা মহিলার তাৎক্ষণিক জবাব এল, ‘জরুর বনেগা ভাইয়া, কাল সুবে বাথরুমমে ভি মালুম পাড়েগা।’

 

এমন সময় কাঠের সিড়িতে ধুপ-ধাপ শব্দ তুলে মঞ্চে প্রবেশ রুপেন আর গৌতমের। রুপেন এক নিঃশ্বাসে ঘোষণা করল, ‘কেইসপুরা জইন্ডিস। তৎকাল শ্যাষ। অখন কি হইব!’

গৌতম একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে আমার সিগারেটটা ঠোঁট থেকে ডাকাতি করে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে চিন্তিত মুখে বলল, ‘সমস্ত জায়গা ঘেঁটে নিয়েছি। বড় এজেন্সিগুলোও আগামী তিন-চার দিন এতগুলো টিকিটের দায়িত্ব নিতে চাইছে না।’

দুই ভগ্নদূতের ঘোষণায়, এক এক জনের গলায় বিভিন্ন বিস্ময়সূচক, প্রশ্নবোধক, এবং সশঙ্ক অভিব্যক্তির বিস্ফোরণ ঘটেছে – ‘তাহলে?’, ‘যাব্ববা!’, ‘এবার কী হবে?’, ‘এখানেই কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে নাকি?’ – ইত্যাদি ইত্যাদি।

‘হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবার দিব্যি কে দিয়েছে’, জয়ন্তদা বলে, ‘সামনের চারদিন দুপুর বারোটায় ঘুম থেকে উঠবো, এখানে মোমোবাজি সেরে নিয়ে, নেহেরু অ্যাভিয়ারি কিংবা হিরিম্বা টেম্পেলে রকবাজি ক’রে, বিকেলে মানালির দোকানদারদের মাথা চেটে, সন্ধ্যেয় হোটেলের ঘরে বসে নিশ্চিন্তে জলকেলি। আর……’

‘হালাবচন শুইন্যা প্রাণ জুড়ায়। চাইর চাইড্ডা দিন কি মদ খাইয়া কাটামু ?’ রুপেন মন্তব্য করেছে।

‘দিন নয় রুপেন, রাত বল’, জয়ন্তদা সংশোধন করল, ‘ওটাই মৌতাতের মাহেন্দ্রক্ষণ।’

রুপেন বলল ‘হের ল্যাইগাই কাইল রাইতে চাতকের মত মদ মদ কইর‍্যা অস্থির হইছিলে, তাইনা?’

‘উদাহরণটা অন্তত ঠিক বলতে শেখ রুপেন’, জয়ন্তদা আবার ধমকালো, ‘চাতক বৃষ্টির জল খায়।’

‘ঐ এক কথাই হইলো’, রুপেন জবাব দিল, ‘তোমার লাইগ্যা সইন্ধ্যাবেলা মদ বৃষ্টি হইলে মানায়।’

শুভাশিস চিন্তিত মুখে বলল, ‘ফালতু তর্ক ছেড়ে এবার সিরিয়াস হও। এই নিয়ে সাত-আটবার মানালি চষা হয়ে গেল।আর কত পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটা যায়। চলো, সিমলাটা  ঘুরে আসি।’

‘এতক্ষণে একখান হক কথা কইছো’, রুপেন মহা উৎসাহে বললে, ‘আইজ সোলাং, কাইল মনিকরণ, পরশু সিমলা, তরশু …………’

‘লাগাম দে রুপেন, মুখে লাগাম দে’, জয়ন্তদা বিরক্ত গলায় রুপেনের ব্রেক কষেছে, তোরা যেভাবে ছাগলের মত চরে বেরানোর প্ল্যান করছিস, তাতে হিমাচলের পরিবহন মন্ত্রীকে তিন’শ কেজি মাল নিয়ে আমাদের পেছনে ঘোরার অনুরোধ করতে হয়।’

এতক্ষণে মুখ খুলেছে দেবরাজ, ‘বরং বিয়াস কুণ্ড ঘুরে এসো, তিনদিনে হয়ে যাবে।’

আমি বললাম,‘যদি বিয়াস কুণ্ডই যেতে হয় তাহলে সিতিধর, লাদাখি চেষ্টা করব না?’

‘সোলো’ সিরিয়াস মুখ করে মন্তব্য করল, ‘কথাটা খারাপ বলিসনি রুদ্র। সময় যখন হাতে আছে তখন চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি।‘

জয়ন্তদা ক্ষেপে উঠেছে, ‘ঐ শালা এক কথা। তোদের এই এক্সপিডিশান মেন্টালিটিটা ছাড় তো। শুধু মটকায় চড়বার শখ! এখানে কি তোদের ভুতে কিলোচ্ছে?’

গৌতম আমাদের সাথে সুর মিলিয়েছে, কথাটার যুক্তি আছে, দল যখন অলরেডি অ্যাক্লাইম্যাটাইজড, র‍্যাশন, ইক্যুইপমেন্ট রয়েছে……’

জয়ন্তদা আবারও ধমকে উঠেছে, ‘ব্যাস, মাথার পোকা নড়ে উঠলো তো ?’

সোলো বলল, ‘তাহলে আইডিয়াটা লোক্‌ কিয়া যায় ?’

আমি বললাম, ‘কোথায় ?’

সোলো আর গৌতম প্রায় সমস্বরে বলল, ‘সিতিধর।‘

জয়ন্তদা বোঝাতে চেষ্টা করেছে, ‘ধর বললেই হয়না, সোলো। বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে। একটা কবিতা শুনেছিস ?

‘অলস মনে শুধুই আনে বিদঘুটে সব বুদ্ধি

ধর ধর করে সবাই, ধরবে কিসের সাধ্যি।’

শুভাশিস বলল,‘এটা আবার কার কবিতা ?’

জয়ন্তদা বলল, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম। মনে নেই।তবে এটা অন্যায়। পাহাড়ের সঙ্গে এতটা পাঙ্গা নেওয়া কি উচিত?’ তবে আমরা জানি, এটা স্বভাবকবি শ্রী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের ছাড়া আর কারোর হতেই পারে না।

‘কে পাঙ্গা নিতে যাচ্ছে’, ওদিকে ঘুরতে যাবো, সুযোগ পেলে চেষ্টা করব।’ বিরক্ত সোলোকে আমি সমর্থন করলাম, ‘না হলে সময়ের মধ্যেই ফিরে আসব। পাহাড়ের মুণ্ড ছুঁতে না পারলে অন্তত পা ………পা …… কি যেন বলে?’ — ‘পাদদেশ’ রুপেন ধরিয়ে দিল। — ‘রাইট। পাদদেশ ছুঁয়ে চলে আসব’, আমি বললাম, ‘কিন্তু এখানে বসে আঙুল চুষবো না। আর যাইহোক, বিয়াস কুণ্ডটা তো দেখা হবে। সেটাই বা কম কিসের !’ 

সেই সময় গরম গরম মোমো এসে হাজির। মুখ দিয়েই বুঝলাম দোকানের মালকিন সোলোর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। ঝালের চোটে গত রাতের খোঁয়াড়ি উধাও। এমনকি রূপেনের মত কাঠ বাঙালও এক কামড় খেয়ে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে, ‘মোমো তো না, হালায় আগুনের গুলা বানাইয়া ছাড়সে।’

 

কিন্তু সোলো, গৌতম আর আমার আলোচনা এখন শুধুই সিতিধর পর্বত ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। কোন রুটে কোন স্টাইলে অ্যাটেম্পট করা হবে, কী ইক্যুইপমেন্ট প্রয়োজন, ওয়েদার ফ্যাক্টর মাথায় রেখে ক’দিনের আরোহণ ইত্যাদি।

জয়ন্তদা তখনও বিরক্ত, ‘দু’দুটো পিক করেও তোদের খিদে মেটেনি? আমি বলে দিলাম সোলো, তোদেরএতটা পিক-ক্রেজ ভালো লক্ষণ নয়।সাবধান হ।’

রূপেন বলল,‘আহা জয়ন্তদা, খামোখা তুমি ঝামেলা পাকাইত্যাছো ক্যান? হেরা শুধু বিয়াস কুণ্ড ঘুরতে যাইত্যাছে।‘

জয়ন্তদা ফেটে পড়েছে রাগে, ‘তুই থাম, দুদিনের বাচ্চা বাঙাল কোথাকার। তুই – ( অভিধান বহির্ভূত) ওদের চিনিস? আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ওদের ধান্দা আলাদা।’

কোন সন্দেহ নেই যে, জয়ন্ত দা রূপেনের চেয়ে আমাদের বেশী চেনে। মোমো সেন্টারে বসেই আমাদের আগামীকালের অ্যাডভেঞ্চারের খসড়া তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের মিটিংয়ের শেষে মোমোর স্যুপের বোলে শেষ চুমুক দিয়ে দেবরাজ দত্ত সভাপতি-সুলভ উপসংহার টেনেছে, ‘অতএব শ্রী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের আপত্তি উপেক্ষা করিয়া অবশিষ্ট সবার সম্মতিক্রমে শ্রীযুক্ত সুব্রত চক্রবর্তী মহাশয়ের নেতৃত্বে শ্রীমান গৌতম সাহা ও রুদ্রপ্রসাদ হালদার আগামী কল্য প্রত্যুষে বিয়াস কুণ্ডের পথে অগ্রসর হইবেন, যদিও তাহাদের প্রকৃত অভিসন্ধি সিতিধর, মানালি বা লাদাখি পর্বতারোহণ এবং শ্রী চট্টোপাধ্যায় ও শ্রীমান রূপেন ভাড়ার সাজসরঞ্জাম লইয়া এনআইএম যাইবেন। বাকি দুই সদস্য ইত্যবসরে অন্যান্য দ্রষ্টব্যস্থানে চরিয়া বেড়াইতে পারেন।’

জয়ন্তদা হাল ছেড়ে দিলেও ঝাঁঝ দেখাতে ছাড়েনি, ‘শালা মোমোর ঝাল তোদের মাথায় উঠেছে !’

মানালির এই অলস দুপুরে মোমো সেন্টারে বসে‘হিমালয়ান ক্লাব’এর এই সাত সদস্যের সাতকাহনের পশ্চাদপটটা একবার চেয়ে দেখা দরকার। গত একপক্ষকাল দরচা থেকে সিঙ্গোলা পাসের ডানদিকের অবিজিত শিণকুন পূর্ব ( ৬০৮০ মিটার ) শিখর আরোহণ করতে গিয়েছিলাম। তখন আমাদের ঐ দলে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সাতাশ বছরের রূপেন এবং সর্বজ্যেষ্ঠ জয়ন্তদা, তেত্রিশ। হাই অল্টিটিউড অ্যাসিস্ট্যান্ট বা শেরপা ছাড়া প্রথমে একটি অনামা ভার্জিন শৃঙ্গে ( ৫৯১২ মিটার) সাতজন এবং পরে ছয়জন ভার্জিন সিনকুন পূর্ব শিখরে চড়তে সমর্থ হই পুরোপুরি অ্যালপাইন স্টাইলে।পরিকল্পিত সময়ের পাঁচদিন আগেই আমরা সাত-সদস্য ফিরে আসি মানালিতে।

এই মানালির মোমো সেন্টারে ঘটে যাওয়া নাটকটাই আমার কাহিনির ভূমিকা। 

২০০৮ সালে হিমালয়ান ক্লাবের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে তৈরি আমাদের ঐ অভিযানের দল উদ্দীপনায় টগবগে। জয়ন্তদার মুখ ঝামটা উপেক্ষা করে তাই সিতিধর অভিযানের খসড়া তৈরি হয়ে গেল। মোমো সেন্টার থেকে হোটেলে ফিরে তাড়াতাড়ি এনআইএম এর মালপত্র পরিষ্কার করে বেঁধে ছেঁদে নিলাম। সিতিধরের জন্য তৈরি হয়ে গেল তিন আরোহীর রুকস্যাক । রাত বারোটায় শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সমস্ত কর্মযজ্ঞের পৌরোহিত্য কিন্তু জয়ন্তদাই করেছে। 

ভোর চারটেয় ফ্লাক্সের চা কোনমতে গলাধকরন করে তিনজন প্রাতঃকৃত্য সেরে নিয়েছি। ঘুমের আবেশ জড়ানো চোখেই ক্লাইম্বিং বুট ( কোফল্যাস ) পরে নিলাম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ জন্মে হয়তো কেউ শোনেনি যে হিমালয়ান রেঞ্জের কোন পর্বতাভিযানে, কোন পর্বতারোহী শহরের হোটেল থেকে ক্লাইম্বিং বুট পরে যাত্রা শুরু করেছে ! 

পৌনে পাঁচটায় হোটেলের সামনে গাড়ি হাজির, সঙ্গে ‘সি-অফ’ করতে বাকি সবাই। পাঁচটায় গাড়ীতে উঠেই শঙ্কিত মনে মানালিকে বিদায় জানিয়েছি। শঙ্কার যথেষ্ট সঙ্গত কারণ রয়েছে – পথ চিনিনা, যে পর্বতে আরোহণ করব তার কোনও পূর্ব পরিকল্পনা নেই। হুজুগটা যে এমন লাফিয়ে উঠে বাস্তবে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে, সত্যি বলতে কি, নিজেরাও আঁচ করতে পারিনি। এটুকুই জানা ছিল যে ধুনডি ( ৯৩০০ ফুট ) পর্যন্ত গাড়ি যায়। ওখান থেকে বিয়াস নদী ধরে উঠলে এক সময় বিয়াস-কুণ্ড পৌঁছে যাবো। ঠিক দেড় ঘণ্টায় গাড়ি পৌঁছে দিল ধুনডি।

 

ধুনডি এ পথের শেষ গ্রাম। যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম সেখানে কোন গ্রামের নামগন্ধ নেই। বেশ কিছু ট্রাক দাড়িয়ে আছে, তিন-চারটে দশাশই তাঁবুতে ঠিকাদারের শ্রমিক বাহিনীর অস্থায়ী সংসার চলছে। তৈরি হচ্ছিল পির-পাঞ্জাল গিরিশ্রেনীকে এফোঁড়-ওফোঁড় করা সুড়ঙ্গ পথ। এক বিশাল কর্মযজ্ঞ । দুই-লেন এর প্রস্তাবিত সুড়ঙ্গপথটি হবে লম্বায় ৮.৮ কিলোমিটার আর চওড়ায় ১০ মিটার । বহু প্রতিক্ষীত প্রকল্পটি বারে বারে পিছু হটলেও, শেষ খবর অনুযায়ী এই বছর (২০১৯) ডিসেম্বরে কাজটি শেষ হবে, এবং এটিই হবে ভারতের দীর্ঘতম টানেল পথ। মানালি থেকে কেলং যাবার পথ ৬০ কিলোমিটার কমে যাবে। স্বভাবতই, সারা বছরের জন্য কেলং–মানালির যোগাযোগ চালু থাকবে। 

ড্রাইভারের নির্দেশিত পথেই আমরা হাঁটা শুরু করলাম। সোলাং উপত্যকায় ঢোকার পর থেকে সামনের বাঁদিকে দৃশ্যপট জুড়ে হনুমান টিব্বার অবয়ব । বিয়াসকে পাশে রেখে টানা দেড় ঘন্টা হাঁটার পর মালুম হল, পথ হারিয়েছি। আরো প্রায় আধঘণ্টা পর এক মেষপালক প্রচলিত পথের সন্ধান দিল।নদী ছেড়ে সে পথ আরো বাম দিক দিয়ে উঠে গেছে। চড়াই ক্রমশ বাড়তে থাকে। উচ্চতার সাথে পাল্লা দিয়ে হালকা হতে শুরু করে পাইন আর বার্চের বনমহল। এ পথে রডোডেনড্রন আর ভূজ প্রচুর দেখা যায়। বেশ কয়েকটি ‘থাচ’ (‘বুগিয়াল’) পেরিয়ে বকরথাচ এর আগে বৃষ্টির কবলে পড়ি। 

মেঘলা দিনে এতক্ষণে বেশ নিরুপদ্রবেই চলছিলাম। এহেন সময়ে বৃষ্টি। পাথরের আড়ালে আশ্রয় নেওয়া এক চরিত্রের সাথে সাক্ষাৎ হল। ইনি পোশাকে আশাকে পুরদস্তুর পর্বতারোহী। কিছুক্ষন লোকটির প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হলাম। ‘আপলোগ কাঁহা যায়েঙ্গে, কাঁহা সে আয়ে হ্যায়, বিয়াস কুণ্ড ট্রেক কর্‌না হ্যায় তো ক্লাইম্বিং শ্যু প্যাহেননেকি কেয়া জরুরত হ্যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। 

অবশ্য প্রশ্নগুলো সঙ্গত। নাম মনে না পড়লেও, ভদ্রলোকের পরিচয়টা ফেলনা নয়। ইনি বর্ডার সিকিওরিটি ফোরসের অফিসার, ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির কিছু ছাত্রকে ইনি এ অঞ্চলে ট্রেকিং করাতে নিয়ে এসেছেন। কথায় কথায় জানা গেল ঐ বছর (২০০৮) উনি কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করেছেন এবং আগের বছর তিরশুলী-পশ্চিম (২৩০৭৪ ফুট ) শিখর আরোহণ করেছেন। প্রসঙ্গত, আমাদের দলের গৌতম, দেবরাজ ও সোলো ঐ বছর(২০০৮) ভারতীয় পর্বতারোহণ সংস্থার (IMF) তরফ থেকে তিরশুলী-পশ্চিম অভিযানে গিয়ে পর্বতশীর্ষ থেকে একটি ‘স্নো-স্টেক’ বা তুষার কীলক নিয়ে আসে যেটা বিএসএফ এর পর্বতারোহীরা ২০০৭ সালে প্রমাণ হিসাবে শীর্ষে রেখে আসে। উপযুক্ত প্রমানের অভাবে বিএসএফ’র এই সাফল্য ভারতীয় পর্বতারোহণ সংস্থা সাথে সাথে মেনে নেয়নি। গৌতমদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অবশেষে বিএসএফ’র ওই সাফল্য স্বীকৃতি পায়।গল্পে গল্পে পাহাড়ি আড্ডা জমে উঠল।যাইহোক, ভদ্রলোক আমাদের উদ্দেশ্য শুনে শুভেচ্ছা জানালেন, সাবধানে ক্লাইম্ব করার উপদেশ দিলেন এবং ফেরার পথে ওনাদের সোলাং ক্যাম্পে বড়াখানার জন্য নেমন্তন্ন করেও রাখলেন।

এরপর একদুটো ছোট গর্জ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বকরথাচ। এখানে মানালি পর্বতারোহণ প্রতিষ্ঠানের কোর্সের সারি সারি তাঁবু পড়েছে। আমরা আর সময় নষ্ট না করে এগোতে থাকি। বোল্ডারের রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে লাফিয়ে পার হতে হচ্ছে ছোটখাটো নালা। পেটে এখনো কিছু পড়েনি। খিদে আর পথশ্রমে সবাই কিছুটা ক্লান্ত। হঠাৎই পাশ থেকে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলাম, ‘আরে রুদ্দর ভাই, তু ইঁহা?কৌন সা শের মারনে আয়া?’ 

ওরা মানালির জগদেও রাম এবং কুলুর কপিল ঠাকুর। আমার ‘সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ’ র কোর্স মেট।কথা বলে জানলাম ওরা মানালি ইন্সটিটিউটের ইন্সট্রাক্টর হয়ে এসেছে। এই প্রথম জায়গাটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পেলাম। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে পশ্চিমদিকে উত্তর-দক্ষিনে বিস্তৃত একটা গিরিশিরা। এই গিরিশিরার উত্তরে লাদাখি (১৭৫২৬ ফুট) এবং দক্ষিণে হনুমান-টিব্বা (১৯৪৫০ ফুট)। আর মাঝখানে ১৬৩৯০ফুটের সোলাং গিরিবর্ত্ম বা টেনটু জোত (পাস)। এই পাস অতিক্রম করে রাভী বা ইরাবতীর উৎসে পৌঁছানো যায়। সোলাং গিরিবর্ত্ম দিয়েই হনুমান-টিব্বা আরোহণ করবার প্রচলিত পথ। পর্বটি ছ’হাজার মিটারের না হওয়ায় ও দুর্গমতার জন্য ইদানীংকালেএই পথে অভিযাত্রীদের পা কমই পড়ে। ধুনডি আমাদের পেছনে বা পূর্বদিকে। ডান অর্থাৎ উত্তরদিকে অল্প দূরে বিয়াস কুন্ড দেখা যাচ্ছে। কুণ্ডের পর উত্তরের পথ দেওয়াল হয়ে লাদাখি, সিতিধর ( ১৭৩৬৮ ফুট ) এবং ফ্রেন্ডশিপ ( ১৭৩৫২ ফুট ) পর্বতে থেমেছে। লাদাখি ও সিতিধরছাড়াও, লাদাখির পেছনে মানালি পর্বত (১৭৫৯৮ ফুট) অবস্থিত। এই পর্বতগুলোই প্রধানত মানালি ইন্সটিটিউটের কোর্সে আরোহণ করানো হয়। শুভেচ্ছা জানিয়ে জগদেও আর কপিল চলে যাবার পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা বিয়াস কুন্ডের পাশে। একে প্রচণ্ড হাওয়া, তার ওপর চড়াই দেখে খিদেটা যেন আরও চাড়া দিয়ে উঠলো। অতএব লম্বা বিশ্রাম। আমি আর সোলো ছাতু মাখতে মাখতে গৌতমের মুখে বিয়াস বা বিপাশার মাহাত্ম্য গিলতে থাকলাম। ছোট ত্রিভূজাকৃতি ডোবা, বিয়াস কুণ্ড ( ১১৬১৮ ফুট ), এখান থেকেই বিপাশার জন্ম। এখান থেকে ৪৭০ কিলোমিটার দূরে শতদ্রুর সঙ্গে সঙ্গম পর্যন্ত এ নদীর নাম বিয়াস। লোককথা অনুসারে এই কুণ্ডের পাশে বসেই ধ্যান করতেন ব্যাসদেব। তাঁর হাতেই রচনা হয় মহাকাব্য “মহাভারত”। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী এই কুণ্ডে অবগাহন করলে স্বর্গবাসের সমতুল্য পুণ্যার্জন হয়। অনেকের মতে ব্যাসদেবের নাম থেকেই বিয়াস নামের উৎপত্তি .

 

সে যাইহোক, আমি মনে মনে একটু দমে গেলাম। বেদব্যাস আর জায়গা পেল না! হিমালয়ে এত সুন্দর সুন্দর জায়গা থাকতে শেষে কিনা ঐ ডোবার পাশে বসে গেল! তবে উৎপত্তি যেখানেই হোক, অল্প পথ পেরিয়ে মানালিতেই বিয়াস ভরা যৌবনা। 

ছাতুর ইন্ধনে আবার নতুন উদ্যমে পথে নামলাম। আঁকাবাঁকা হয়ে পথ চলছে উপরের দিকে। বেশ কষ্ট হলেও, যতটা পারি এগিয়ে থাকতে হবে আমাদের। সাড়ে তিনটের সময় মন আর পা সায় দিল না। তাঁবু পাতলাম ১৩৫০০ ফুটে। তাঁবু বলতে ডোমটেন্টের ‘আউটার শীট’ এবং ‘টেন্ট পোল’। ওজন লাঘব করবার সদিচ্ছা আর কি। প্লাস্টিক গ্রাউন্ড শিট বিছিয়ে ভেতরে এক রাতের সংসার পাতলাম। আজ আর কাজ নেই, তাই সন্ধ্যার আগে রাতের খাবারখেয়ে শয্যা নিলাম। 

আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে রাত দুটোয় এই শিখর শিবির থেকে শীর্ষের উদ্দেশ্যে বেরনো। চারদিকে মেঘ গুড় গুড় পরিবেশে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। ঘুমের দফারফা হয়ে গেল পিঠের নিচে ঠাণ্ডা অনুভূতিতে। প্রবল বৃষ্টির জল প্লাস্টিক শিটের নিচ দিয়ে গড়াচ্ছে। সোলো পাশ ফিরে বলল, ‘এখন ভেবে লাভ নেই, রুকস্যাকটা পিঠের নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়।’ আমি ঘুম জড়ানো চোখে বললাম, ‘সিতিধরকে কি আর ধরা যাবে না?’ গৌতম স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে কৌতুক করে বলল,’তিনটোছিয়া দেইখা কেলা পিকটো ডরাইন গেছে, দেইখতে লারছিস নাই, ব্যাটার কান্না থাইমছেক লাই।’ অসাবধানতায় বা আবেগে মাঝেমধ্যেই গৌতমের অরিজিনাল ভাষা বেরিয়ে যায়। এরপর কি আর ঘুম আসে !  তিনজনই মটকা মেরে পড়ে রয়েছি। যখন বুঝলাম তাঁবুর ফ্যাব্রিকের উপর এই ঝম-ঝমা-ঝম নৃত্য আর থামবে না। তখন আমরা পরিপাটি করে ঘুমের সেকেন্ড ইনিংস শুরু করলাম। 

‘কটা বাজে?’ – সোলোর ডাকে ঘুম ভাঙল। আড়মোড়া ভেঙ্গে গৌতম বলল, ‘সাড়ে আটটা, এই রুদ্র ফ্ল্যাপটা টেনে দেখনা।’ বাইরে তাকিয়ে ঘোলাটে মেঘের ফাঁক দিয়ে আবছা সিতিধরকে দেখে বললাম, ‘দ্যাখ শালাটা চোখ মারছে।’ সোলো ধড়মড়িয়ে উঠে স্লিপিং ব্যাগের জিপার খুলতে খুলতে উত্তর দিল, ‘তুই ও মেরে দে।ওকে বল, আসছি। রেডি হ।’ গৌতম বিরক্ত মুখে বলল, ‘সামিট প্রুফ করা যাবে নাতো ?’ আমি গলা চড়ালাম, ‘নিকুচি করেছে তোর প্রমাণের। চল, ওর বুকে খানিকটা মুখ ঘষে আসি।’ 

আধঘণ্টার মধ্যে নুডলস খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হাতে সময় কম। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে হাতের নাগাল থেকে পিকটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বেলা সাড়ে বারোটায় ‘স্নো-লাইন’ ( ১৫০০০ ফুট) শুরু হয়েছে। এরপর বামদিকে ওপরে ‘সিতিধর কল’ থেকে ডান দিকে সামিট রিজ। বোধহয় ওটাই প্রচলিত পথ। সোলো হঠাৎ আমাদের দিকে তাকিয়ে আরোহীসুলভ গলায় বলল, ‘পিক করতে হলে সোজাসুজি চেষ্টা করতে হবে।যাবি ?’ আমি আর গৌতম সায় দিতেই শুরু হয়ে গেল রক ক্লাইম্বিং। বেশির ভাগ সময়টা সোলোই ‘লিড’ করল। পাথর আর বরফের ‘মিক্সড জোন’ দিয়ে আরোহণ করতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যেই হুড়মুড়িয়ে নেমে আসছে স্লেট পাথরের দল। অতি সাবধানে বিলে করতে করতে এগোচ্ছি। একরাশ ভয় গ্রাস করেছে, মনে একটা দ্বিধা!ফিরে যেতে হবে? এত কাছ থেকে ফিরতেও মন চাইছে না। আমাদের এত চেষ্টা, এত উদ্যম বিফলে যাবে! পাথরের ফাটলে তুষার-গাইতি আর ‘ক্র্যাম্পণ’ এর সাহায্যে কখনও ৪০- ৫০ ডিগ্রি বা কখনও ৬০-৬৫ ডিগ্রি ঢাল বাইতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও সে আবার ৭০-৮০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে সিতিধর শিখর, ‘বিনাইটমেন্টে’-র কথাও আমাদের মাথায় আছে, কেননা যখন তখন আবহাওয়া বিগড়ে যেতে পারে। হালকা ‘হোয়াইট আউট’ হয়ে আছে। ঠাণ্ডার তীব্রতাও যথেষ্ট।মাথারদশ মিনিট আগে বুঝতে পারলাম সিতিধর আমাদের ধরা দিচ্ছে। বড় আনন্দের সময় আমাদের কাছে। শিখরে সময় দেখার জন্য গৌতম মোবাইল ফোন বের করে আবিষ্কার করল,ওর মোবাইলে বিএসএনএল এর নেটওয়ার্ক তখনও অ্যাক্টিভ।

 

বিকেল পাঁচটা কুড়িতে ছবি তুলতে গিয়ে জানলাম আমরা কেউই সিতিধরের উচ্চতা জানি না। অগত্যা মধুসূধন। তৎক্ষনাৎ কলকাতাতে আমাদের সব সমস্যার সমাধান চন্দ্রদাকে (শেখর ঘোষ) ফোন করে জানতে পারলাম। সাদা পতাকার উপর মার্কার দিয়ে সোলো সিতিধরের উচ্চতা লেখার পর, ছবি তোলার পালা। অনেক নীচে আমাদের শিখর শিবির তখন মেঘে ঢাকা এবং অদৃশ্য। অবাক কান্ড, এর মধ্যে মেঘের যবনিকা ছিঁড়ে কিছু কিছু দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হল। দক্ষিণে হনুমান টিব্বার ধ্যানগম্ভীর রূপ ক্যামেরা বন্দী হল। পশ্চিমে লাদাখি, মানালি মেঘে ঢাকা থাকলেও ‘সি-থ্রু’ পর্দা দিয়ে দেখতে পেলাম আবছা ম্যাকারবে (১৯,৯১১ ফুট) এবং সিকারবে (২০,৩৪০ ফুট) কে। কেন জানি না প্রযুক্তিগত ভাবে চ্যালেঞ্জিং এই দুটো শিখর কে কেন পর্বতারোহীরা ব্রাত্য করে রেখেছে। ১৯৫৫ সালে রয়্যাল এয়ার ফোরস প্রথম ‘সিকারবে’ আরোহণ করে। তারপর পুনের একটি দল ঐ পর্বতে আরোহণ দাবি করলেও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০০০ সালে একটি দল চেষ্টা করে। ব্যাস্‌, কোন অজ্ঞাতকারণে আর কেউ সে পথ মাড়ায়নি। 

এবার আমাদের নামবার পালা। জানি, মানালি পৌঁছলেই বাকি সদস্যদের উষ্ণ অভ্যর্থনা আর আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ব। রূপেন বলবেই, ‘হালা, পিক কইরা আইছো, তগো লাইগ্যা কারণ বারির একখান বিয়াস-কুণ্ড রাখ্‌সি। ডুইবা মর।’

 

************

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!