শুনতে পাচ্ছো, দীপঙ্কর…?

শুনতে পাচ্ছো, দীপঙ্কর ...? : অরুণকান্তি ঘোষ
শুনতে পাচ্ছো, দীপঙ্কর ...? : অরুণকান্তি ঘোষ

এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্বতারোহী দীপঙ্কর ঘোষ এবছর মে মাসে তাঁর দ্বিতীয় মাকালু অভিযানে শিখর ছুঁয়ে ফেরার পথে আচমকা অপ্রত্যাশিত তুষারঝড়ের কবলে পড়ে পর্বতগাত্রেই সমাহিত হয়ে গেলেন। তাঁর নশ্বর দেহ ফিরেছিল বটে, তিনি ফেরেননি। সম্প্রতি ভারত সরকার উচ্চতম হিমালয়ে দীপঙ্করের অনন্য ধারাবাহিক যত কীর্তিকথা মনে রেখে তাঁকে মরণোত্তর ‘তেনজিং নোরগে পুরষ্কার’ দিয়ে সম্মানিত করেছে। সেই আজীবন অভিযাত্রী দীপঙ্করের স্মরণে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন অরুণকান্তি ঘোষ।

দীপঙ্কর, তুমি ফেরোনি, জানি। তবু গিয়েছিলাম বিমাবন্দরে, যেমন আরও অগণন মানুষ গিয়েছিলেন।কলকাতা এয়ারপোর্ট এর ঝাঁ চকচকে টার্মিনাল বিল্ডিং, পুরনো বাড়ি, কন্ট্রোল টাওয়ার –অনেকটা চক্কর দিয়ে পৌঁছই জৌলুসহীন কার্গো বাড়ির সামনে, মালপত্র নিকাশির নিত্য ব্যবস্থা যেখানে। অন্যদিন জায়গাটা প্রায় শুনশান থাকে, কিন্তু এই বিকেলের ছবিটা ভিন্ন। এত লোকের ভিড়, ফ্ল্যাগ ব্যানারে সাজানো চত্বর। সবখানে তোমার ছবি, তোমার উদ্দেশে ভালোবাসার বাক্যবন্ধ। এসেছে সবাই, বন্ধু-সহযাত্রী-ছাত্রছাত্রী-অনুগামী, তোমায় বরণ করে নেবে বলে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে থেকে রাত। অপেক্ষার যেন শেষ নেই।
অবশেষে কার্গো ভবনের বাহির দরজা দিয়ে কফিনবন্দী তুমি ক্রেনবাহিত হয়ে নেমে এলে অপেক্ষমান শব-শকটের পাটাতনে। তখন প্রায় ন’টা। দুপুরের ফুল হাতে হাতে শুকিয়ে গেছে। অথচ কাঠমান্ডু থেকে উড়ান এসে নেমেছিল ০৭-১৫টায়। পায়ে হেঁটে এলে দশমিনিটে চলে আসতে তুমি। সেতো হবার নয়। তবু ফুলে ফুলে আড়াল হতে থাকা বাক্সে রাখলাম একটি শ্বেতপদ্মের বৃত্ত। মুহূর্তে মনে হ’ল, তুমি এখানে নেই। তুমি এখনো বরুণ উপত্যকা-অধিপতি শ্বেতদানব মাকালুর সামিট-রিজের ‘পরে দাঁড়িয়ে আছো অবরোহণ মুদ্রায়! কেন ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছো জানি না, বুঝতে চেষ্টা করি। আপাতত এটুকু বুঝি, এখানে তুমি নেই। তাই এ চিঠি– দীপঙ্কর ঘোষ,বরুণ ভ্যালি, মাকালু সামিট-রিজ –এই ঠিকানায় লেখা।
ঠিকানাটা ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। কেননা তুমি এর আগে গিয়েছিলে মাকালু অভিযানে। সেবারে পৌঁছেও গিয়েছিলে প্রায়, মাত্র ১৭০/১৮০ মিটার নীচ থেকে ফিরতে হ’ল। কারণ? কী আশ্চর্য! এত বড় অভিযানে দড়ি কম পড়ে যায়! এরা নাকি পেশাদার! অথচ সেদিন সবই ঠিকঠাক ছিল। তোমার শেরপা বন্ধুটিকে বলেছিলে, ‘চলো দুজনে ফ্রি-হ্যান্ড ক্লাইম্ব করি, অল্টারনেট রোপ বিলে করে দুজনে সামিট ছুয়ে আসি।’ সে রাজি হয়নি, দড়ি ছাড়া যেতে তার আতঙ্ক জেগেছিল। ওই অভিযানের (২০১৩) ছবি আমি দেখেছি, দেখে বুঝেছি আকাশ বাতাস সব অনুকূল ছিল। একটা সহজ ঢালের নগ্ন পাথরের শিখরমুখি শিরা, ঘণ্টা দুই/তিনের মার্চ। তারপর মাকালু সামিট। তবু হ’ল না। তুমি জাত অভিযাত্রী, তাই মেনে নিয়েছিলে, ‘আজ যা হয়নি, আগামীকাল হবে বলেই হয়নি।’ আমরা এত সহজে মানতে পারিনি। আমি খুব ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয় কাগজে সম্পাদকীয় শানিয়েছিলাম। থাক সে কথা। এবারে নিশ্চিত ছিলাম যে মাকালুর মেগা-এপিসোড শেষ হবে, সব অসমাপ্ত গল্প ঠিকঠাক লেখা হয়ে যাবে।
অজস্র সব ছবি লম্বা স্লাইড শো’এর মতো আসছে, আর মিলিয়ে যাচ্ছে। তুমি যাচ্ছো, লোকে চেয়ে দেখছে। যদিও সর্বজনের এই চেয়ে দেখা বেশিদিনের নয়, একদশকের – তোমার এভারেস্ট ছুঁয়ে আসার পরে। অথচ তার কত আগে শুরু হয়েছে তোমার ‘অগমপারের অভিসার’! খুব মনে পড়ে, দুন এক্সপ্রেস এর কামরায় দেখা হয়েছে আমাদের – তুমি ও প্রসেনজিত ফিরছ ‘নর-পর্বত’ সামিট থেকে, আমরা গঙ্গোত্রী হিমবাহ এলাকায় লম্বা ট্রেক সেরে। তুমি সামিটের অভিজ্ঞতা বলছিলে, কীভাবে এক নেকলেস ক্রিভাস তোমাদের সামিটে পা রাখা প্রায় আটকে দিয়েছিল। সেই প্রথম আমরা শুনছি একজন আরোহীর মুখে তার শিখরে যাওয়ার গল্প। সবাই জানে, তুমি বড় কম কথার লোক। তা হবে। কিন্তু আমরা জানি, গল্প বলায় তুমি কত সাবলীল ছিলে। হ্যাঁ, সেদিন রেলের কামরায় বসে অনেক গল্প হ’ল। হঠাৎ পৃথিবীটা যেন বড় হয়ে গেল। তারপর বেশ ক’বছর আমরা পাহাড়ি কাজে জড়িয়ে গেলাম দলগত ভাবে। শুরু হয়ে গেল শীতের শিবির।
ঘরের লোক ছাড়াও এক ঝাঁক ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এলো adventure এর নেশায়। শহর থেকে দূরে চারদিনের এক শিবিরে থেকে যে এক স্বপ্নের দুনিয়ায় ঘুরে আসা যায় – সত্যি, এ আমাদের ধারনায় ছিল না। আনন্দ, শ্রম, শৃঙ্খলার কী অসাধারণ সমন্বয়! প্রাণশক্তির কী অসামান্য প্রকাশ! শীতের ছুটি এলেই ছেলেমেয়েরা মুখিয়ে থাকে, কতক্ষণে যাবে ছুটে সদলে পাহাড় চড়া শিখতে – শুশুনিয়া, ঝলাদা, জয়চণ্ডী, কিম্বা মাঠাবুরু। আর আমরা? আমরা মুখিয়ে থাকতাম, কখন দেখবো পাহাড়কোলে শতফুল ফুটছে তোমাদের হাতে। আমাদের তখন শেখার বয়স নেই, তবু দেখে শিখছি। পাহাড়ে চড়ার রকমসকম, কায়দাকানুন। দড়িদড়ার যত বিচিত্র কারিগরি। রাজীব, প্রসেনজিত, সুব্রত, সৌম্য ও তুমি নিজে পাহাড়ে ফ্রি হ্যান্ড ক্লাইম্বিংয়ের যে নমুনা পেশ করতে, দেখে আমাদের চমক লাগতো। রক ফেসে তোমাদের মনে হতো এক একজন স্পাইডারম্যান! আর তুমি ছিলে ‘রিয়াল ম্যাজিশিয়ান’! আরোহণকে তুমি নিয়ে যেতে নান্দনিক উচ্চতায়। তুমি দেখিয়েছিলে – পাহাড়ের গা বেয়ে শির পর্যন্ত যাওয়া পৃথিবীর সেরা দৃশ্যের একটি। আমরা তোমার পর্বতাভিযান প্রত্যক্ষে দেখিনি, দেখেছি গল্পে, ছবিতে। কিন্তু বাঙলার নানা রক ফেসে তোমার ফ্রি হ্যান্ড আর টেকনিকাল ক্লাইম্ব চোখের সামনে দেখে বুঝেছি, তুমি ছিলে সেরাদের একজন। অমূল্য সেন একবারএকান্তে আমায় বলেছিলেন – Dipankar is the most accomplished climber, he is so smoth, effortless and equally disciplined… আরোহীমহল এটা মানতো। তবু কোথাও কি ভুল হয়ে গেল? জানি না।
দীপঙ্কর, তোমাদের সঙ্গে থেকে ওদের এক পৃথিবী গড়ে উঠেছিল। ফি’বছর ক্যাম্পফায়ারের রাতে নাচ গান নাট্য সমন্বয়ে যে উৎসব উপহার দিতে সেখানে সংস্কৃতির এক অনন্য আবহ সৃষ্টি হতো। তার মধ্যে যেমন শিকড়ের যোগ থাকতো, তেমনি থাকতো আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া। আমরা তখন তুলনায় বেশ প্রবীণ, তবু তোমাদের কাছ থেকেই নিয়েছি স্বপ্ন চিন্তা অভিজ্ঞতা, দিনের পর দিন। ক্যাম্পসাইটে ধূমপান মানা ছিল, তাই ডিনার সেরে ক্যাম্প-সাইট ছেড়ে পাশের প্রান্তরে গিয়ে মজলিশে মিলতাম। সে ছিল সঞ্চয়ের রাত। কথায় কথায় জেনে নিতাম কী মতলব ঘুরছে তোমার মাথায়। প্রায়ই বেরিয়ে পড়তে কিনা। পাহাড়ে, প্রশিক্ষণে, কিম্বা প্র্যােকটিসে। আসলে তখনও তুমি শিখছ। বুঝতাম, পর্বত অনেক চায়। তার জন্য নিজেকে আরও বেশি প্রস্তুত করতে হয়। তার মধ্যে NIM (নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং) এর সব কোর্স সারা। একে একে চলে যাচ্ছ শ্রীকণ্ঠ, কেদার, যোগিন, গঙ্গোত্রী শিখরে। আমাদের রাতের মজলিশগুলির অন্যতম বিষয় ছিল, মেগা এক্সপিডিশন। জিজ্ঞেস করতাম, ‘দীপঙ্কর, তোমরা মেজর পিক নিয়ে ভাবছো না কেন? তোমরা তো কেপেবল্‌।’ সেই মুহূর্তে তোমাকে কেমন শরবিদ্ধ মনে হতো। বলতে, আপনি মেজর পিক বলতে কি এভারেস্ট মিন করছেন?
– হ্যাঁ, এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, বা ধরো আমাদের নন্দাদেবী।
– হবে না। তার মানে এই নয় যে আমরা পারি না, আমরা যথেষ্ট কেপেবল। কিন্তু এত বড় বাজেট সামাল দেবে কে? এখন তো দলগত এক্সপিডিশন হচ্ছে না, ক্লাবগুলো এগিয়ে আসছে না। কারণ ওই বাজেট। একটা মাঝারি পিক বেছে নিলেও বিশাল টাকা লাগে। সেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট মানে বহুলক্ষ টাকা। কে দেবে বলুন?
– ফাউন্ডেশন এগিয়ে আসছে না?
– ফাউন্ডেশন এখন ঠুঁটো জগন্নাথ। তবে একসময় যথেষ্ট করেছে – ৯১, ৯৩, ৯৫ এ যখন পর পর এভারেস্ট অভিযান হ’ল। সাকসেস এলো না, তাই হয়তো হাল ছেড়ে দিলো।
– পর পর এক্সপিডিশান, তবু সাকসেস এলো না কেন?কোথায় ভুল ছিল?
– আমি এ নিয়ে কিছু বলছি না। শুধু বলবো যে, আমরা পারি, যদি সেরকম সাপোর্ট পাওয়া যায়।
– গৌতম (দত্ত) বলেছে, প্ল্যানিং লিডারশিপ ঠিক থাকলে এভারেস্ট শুধু সময়ের অপেক্ষা।
– গৌতমদা ঠিক বলেছেন, আমিও জানি, এভারেস্ট অপেক্ষা করছে।
হ্যাঁ, এভারেস্ট সত্যিই অপেক্ষা করেছিল। বসন্ত সিংহ রায় ও দেবাশিস বিশ্বাস যেবার (২০১০) শীর্ষ স্পর্শ করে ফিরে এলো, বুঝেছিলাম, তোমার স্বপ্নটাও হাতের কাছে। পরের বছর রাজীবকে (ভট্টাচার্য) সঙ্গী করে চলেও গেলে হিলারি-তেনজিংয়ের রাস্তা ধরে। তুমি ৮০০০ মিটার ক্লাবের ছাড়পত্র পেয়ে গেলে। তারপর? Adventurer never looks back – অভিযাত্রী পিছনে ফিরে চায় না। তুমিও চাওনি। পায়ে পায়ে চলে গেছ একে একে লোথসে, মাকালু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা, মানাসলু, ধৌলাগিরি, চৌ-ইউ, এবং আবার মাকালু। বন্ধুরা বললে, তুমি নাকি কে-২ অভিযানের খসড়া সেরে রেখেছিলে মনে! এবং তুমি নাকি নেপালের নাগরিকত্ব আদায়ের তোড়জোড়ও করেছিলে।

অনেককাল কথা হয়নি আমাদের। শেষবার যেটুকু হ’ল দূরভাষে, তোমার ধৌলাগিরি অভিযানের (২০১৭) ঠিক আগে, বলেছিলে, ফিরে এসে একদিন জমিয়ে আড্ডা হবে। মাঝে যত কথা বাকি রয়ে গেছে, সব সারা হবে। বলেছিলে, কিন্তু ফুরসৎ আসেনি। আমরা যতবার এখানে মজলিশের আয়োজন করি, তুমি তখন পায়ে হেঁটে আকাশের দিকে যাও। এরকম হতো প্রায়শই। আসলে আমরা বরাবর খণ্ড আকাশ নিয়ে খুশি থেকেছি, তুমি থাকোনি। তোমার সীমানা ছিল আকাশ। কতবার আমিই মনে করিয়ে দিয়েছি তোমাকে, Sky is your limit… যখনই তুমি এক্সপিডিশনে যাওয়ার প্ল্যান করতে, বা সময়ে নোটিশ জারি করতে, ‘আমি যাচ্ছি, অমুক পর্বত অভিযানে’ – আমার ছোট্ট কমেন্ট থাকতো, ‘আকাশ তোমার সীমানা!’ সত্যিই তাই। তুমি প্রতিবার পায়ে হেঁটে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে, শীর্ষে দাঁড়িয়ে অনন্ত নীল শামিয়ানায় শরীর জড়িয়ে অনশ্বর বিশ্বের স্বাদ নিতে। হ্যাঁ, তুমি চেয়েছিলে, হিমালয়ে যত শীর্ষবিন্দু আছে সবখানে দাঁড়িয়ে আকাশ ছুঁয়ে দেখবে! তাই তুমি সব দিকেই বাড়িয়ে রেখেছিলে পা। পায়ে পায়ে অগণন শীর্ষ ছুঁয়েও আকাশ ছোঁয়ার সাধ ফুরোয়নি তোমার। যেতে যেতে যেতে সেই আকাশ ছুঁয়ে স্থিরচিত্র হয়ে থেমে গেলে বরাবরের মতো। আর ফিরলে না।কথা যে বাকি রয়ে গেল, দীপঙ্কর…
তোমার দীর্ঘতম সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি, কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের পরে। সেবারে কলকাতা থেকে এক ঝাঁক আরোহী গিয়েছিল। রাজীব, ছন্দা, টুসি, আরও কারা যেন ছিল সেই দলে। তুমি নিজে তো ছিলেই। তবু সেটা দলগত অভিযান ছিল না। সেবারেই ছন্দা’র ট্রাজিক পরিণতি ঘটে – কঞ্চনজঙ্ঘা সামিট সেরে ইয়ালুং-কাং সামিটের দিকে যেতে যেতে সে হারিয়ে যায় বরাবরের মতো। আমার বিশ্বাস ছিল (আজও আছে), এক দলে থাকলে ট্রাজিক পরিণতিটা এড়ানো যেতো। আমার প্রশ্নের উত্তরে তুমিও বলেছিলে, ‘অরুণদা দলগতভাবে যাওয়া অভিয়ানকে অনেকটা নিরাপদ করে, Going together is the best possible way… কিন্তু আমাদের এখানে এটা আর হবে না। টিম এক্সপিডিশনের দিন শেষ। কোম্পানি রাজ শুরু হয়ে গেছে। যে যার মতো টাকা জোগাড় করে বেরিয়ে পড়ছে, কেউ সঙ্গে গেল কি গেল না, খুব কিছু ম্যাটার করছে না। আজকের গ্রাউন্ড রিয়ালিটি, আরোহীদের মানসিক গঠন, দলগত অভিযানের বিরুদ্ধে।’ তুমি ব্যথিত ছিলে মনে, তবু সময় নিয়তিনির্দিষ্ট এই জ্ঞানে মেনে নিয়েছিলে সব। এবং ‘দুর্গমের অভিসারে’ তুমি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছিলে একলা পথিক!

সেবারে (এপ্রিল ২০১৩) হাওড়া স্টেশনে অনেকে ছিলেন। যাচ্ছো মাকালু অভিযানে। এত ফুল জমা পড়েছে তোমার হাতে, ভেবে পাচ্ছিলে না কোথায় রাখা যায়। রাজীব প্রসেনজিতেরা সামাল দিলো ব্যাপারটা। বড় ডাফেল ব্যাগ উঠে গেল কামরায়। উপহারের বাক্স জড়ো হয়েছিল অজস্র, কিন্তু প্রশ্ন সেই এক – এতসব রাখা হবে কোথায়? কী আর করা, বন্ধুরা বাছাই করে গুছিয়ে দিল। অমূল্যদা ফ্ল্যাগ তুলে দিলেন তোমার হাতে। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে, সবাই প্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, তুমি উঠে গেলে একা। জানতাম একাই যাচ্ছো, আগের রাতে ফোনে কথা হয়েছে। তবু কেন জানি না, ছাড়ার মুহূর্তে করেই ফেলি প্রশ্নটা, ‘একজন সঙ্গী পাওয়া গেল না দীপঙ্কর? ‘তুমি বললে, ‘চেষ্টা করেছি অনেক, শেষে বুঝেছি সঙ্গীর আশায় পড়ে থাকলে যাওয়াই হবে না আমার। তাছাড়া অভিযানে গেলে সঙ্গী জুটে যাবে ঠিক।’ কথা সত্য ছিল। ততদিনে তুমি বিশ্বনাগরিক হয়ে গেছ। রুশ, স্প্যানিশ, কোরিয়ান সবাই তোমার বন্ধু, সহযাত্রী।

সেই থেকে তুমি রওনা দিতে একা, ফিরেও আসতে একা। মাঝে অভিযান পর্বে অবশ্য একা ছিলে না কখনও। নানা দেশের মানুষদের নিয়ে এক একটা পরিবার গড়ে উঠত হিমালয়ের গোপনপুরে। পর্বত অনেক চায়। সেইমতো নিজেকে প্রস্তুত করেছিলে দুই দশক ধরে। তবু তুমিই জানতে পর্বতের সব চাওয়া একা পুরন করা যায় না। সেখানে সমন্বয়ী সহযাত্রা চাই। কঠিন সময়ে একটুখানি জল, ফিক্সড রোপে একটা পোক্ত anchor, কাঁধে একটি ভরসার হাত – এইসবই অভিযানে আত্মীয়তার বাঁধন। রাতের শিবিরে যখন শূন্যের অনেক নীচে চলে যায় পারদ, তাঁবুর ভিতরে অভিযাত্রী পরিবারে শুরু হয় ভিন্ন আবাহন। গল্প বলে, গান গেয়ে, কখনও শুধু হাসি বা অশ্রু দিয়ে শরীরে মনে সঞ্চারিত হয় উষ্ণতার প্রবাহ। একসাথে থাকা ও যাওয়ার এই মানে তুমি ছাড়া কজন বুঝেছে জানি না। বা, তুমি যেমন করে বুঝেছিলে আর কেউ কি বুঝেছিল? আসলে তুমিই বার বার বাড়িয়ে দিতে হাত, তুমিই অপেক্ষা করতে, করতে চাইতে।

যেমন করেছিলে টুসি বা ছন্দার জন্য – কাঞ্চনজঙ্ঘার স্বর্ণচূড়া থেকে নামার পথে। তখন সন্ধে। টুসির শেরপা ওকে ছেড়ে এসেছিল মাঝরাস্তায়, ছন্দার নামতে সমস্যা হচ্ছে। তুমি সামিটক্যাম্পের কাছাকাছি, ওপর থেকে কারও হাঁক শুনে থেমে গেলে। টুসির গলা। কিছু বিপদ ঘটেছে। কষ্ট-ক্লান্তির প্রান্তে দাঁড়ানো তুমি তক্ষুনি উঠে যেতে চাইলে। পাসাং (তোমার শেরপাবন্ধু) তোমাকে বিস্তর বুঝিয়ে নিজেই উঠে যায়। ওপরে চেয়ে দেখলে নেমে আসছে ছন্দা ও রাজীব। অন্ধকারে ওদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। তুমি হেঁকে বললে হেডটর্চ জ্বালিয়ে নিতে। ছন্দা বললে, ‘হেডটর্চ জ্বলছে না, একটু দাঁড়াও দীপুদা, তোমার হাত ধরে যাবো।’ তুমি বাড়িয়ে দিলে হাত, যা তোমাকেই মানায় সবচেয়ে বেশি। ওর হাত ধরে দুজনের এংকর সামাল দিয়ে সতর্ক পায়ে নেমে এলে সামিট ক্যাম্প। পিছনে রাজীব। তোমার তাঁবু ছিল সবার আগে। ছন্দাদের বেশ পিছনে। তুমি চেয়েছিলে ওকে তাঁবু পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আসতে। ছন্দা বলেছিল, ‘তুমি রেস্ট করো, দীপুদা। আমি ঠিক চলে যাবো।’ সেই তোমাদের শেষ কথা, সম্ভবত শেষ দেখাও। কেননা ঠিক পরের দিন একই সামিট ক্যাম্প থেকে সে রওনা দিয়েছিল ইয়ালুং-কাং এর উদ্দেশে, আর ফেরেনি। তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি বারণ করলে না, দীপঙ্কর? তুমি তো জানতে এটা সুইসাইডাল!’ উত্তরটা এখনও কানে বাজে–
– না অরুণদা, বারণ করিনি। আমি হাত বাড়াতে পারি, পথ আগলাতে পারি না। তাছাড়া আমরা তো একদলে ছিলাম না।
– কিন্তু তুমি ছিলে সিনিয়রমোস্ট।
– সেও সমস্যা। ও শুনতো না। ওর মাথায় স্পন্সরের চাপ ছিল। তবে আমি জানতাম না যে ও লোয়ার ক্যাম্পে রেস্ট না করে পরের দিনই ছুটবে। আমি নিজে পারতাম না এটা।

ছন্দার ঘটনা পর্বতে সমতলে সবাইকে ধাক্কা দিয়েছিল, তোমার কষ্ট ছিল গভীরে। এক পর্বতে এক সময়ে ছিলে, অথচ করার কিছু ছিল না। পরের বছর তোমার এই হাত-বাড়ানোর অনন্য নজির দেখলাম। গিয়েছিলে অন্নপূর্ণা অভিযানে, ক্যাম্প-৩ পৌঁছে গিয়েছিলে, সামিট ক্যাম্পে যাওয়ার অপেক্ষা। হঠাৎ খবর পেলে প্রলয় ভূকম্পে তছনছ হয়ে গেছে অর্ধেক নেপাল। আমরা জানি, কী ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিল দাপিয়ে গেছে সেখানে; এক এভারেস্ট এলাকায় কতজনের তুষারসমাধি ঘটেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, তখন অন্নপূর্ণা অঞ্চল নিরাপদ! আকাশ বাতাস শরীর মন সব অনুকূল। সামিট শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু তুমি শিখর ছেড়ে নেমে এলে মাটিতে। তোমার নিজের কথায়, ‘আমার মনে হ’ল, শিখর স্পর্শ করার চাইতে অনেক বেশি দরকার মানুষের হাত ধরা।’ নীচে জনপদে এসে তুমি ত্রানের কাজে নেমে পড়লে, রয়ে গেলে বিপন্নদের সাথে দিনের পর দিন। দীপঙ্কর, মানুষ যে কত বড় মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তোমাকে না দেখলে…! এক জীবনে অনেক শীর্ষ ছুঁয়েছিলে তুমি, এরই মধ্যে মানবিকতার যে শীর্ষ তুমি ছুঁয়েছ সে বুঝি তুমি নিজেও জানতে না। আজ বিমান (বিশ্বাস) হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, সীমান্তে পাহারাও দিচ্ছে নিশ্চয়ই। অথচ সেদিন ধওলাগিরির হিমানীপ্রাচীরে সে মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। এই বিমান ছেলেটি ছিল ইন্দো-তিব্বতীয় সীমানা রক্ষীবাহিনীর ধওলাগিরি অভিযানের একজন আরোহী। সামিট থেকে ফেরার সময় সে কী করে দলছুট হয়ে গেল তার ব্যাখ্যা মেলেনি আজও। তবে সময়ের সমাপতনে তুমিও নামছিলে তখন তোমার শেরপা বন্ধুর সাথে শিখর থেকে সামিট ক্যাম্পের পথে। দেখলে, বিপজ্জনক ঢালে একলা থেমে আছে এক যুবক, যেন চিরদিনের মতো থেমে গেছে সে। পাশে দাঁড়ালে তুমি, কাঁধে রাখলে হাত। সে একপলক দেখে চিনেছে তোমাকে। হয়তো অভিযান পর্বেই হয়েছে চেনা। কোনওমতে সে শুধু বলেছে, ‘দীপুদা, আমাকে বাঁচাও।’ তুমি সব চেষ্টা করেও যখন তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে পারলে না, ছেড়ে দিলে তোমার শেরপাকে। ওর সঙ্গে প্রায় ৮০০০ মিটার উচ্চতায় ওই বিপজ্জনক প্রাচীরের গায়ে কাটিয়ে দিলে মাইনাস চল্লিশ তাপাঙ্কের রাত। মৃত্যুর সাথে এক অসম অবিশ্বাস্য লড়াই! কিন্তু না, জিতে গেলে তুমি! পরদিন তাকে নিয়ে নেমে এসেছিলে সামিটক্যাম্প। হ্যাঁ, বিমান বেঁচে গেল। মূল্য দিলে তুমি, তুষারক্ষতে আক্রান্ত অধিকাংশ আঙুলের অনেকটা বাদ দিতে হ’ল। অন্যদিকে এত বড় উদ্ধারকাজের সামান্য স্বীকৃতিও দিলে না ITBP কর্তৃপক্ষ। ভাবা যায়!

এত কিছুর পরেও দুর্গমের অভিসারে যাওয়া ফুরোয়নি। আবার পর্বতে চলে গেছ, আবার ছুঁয়েছ শীর্ষবিন্দু,আবার দুহাত দিয়ে সারা আকাশ ধরতে চেয়েছ। ওই যে, কে-২ অভিযানের মতলব করেছিলে। তুমিই বোধকরি প্রথম ভারতীয় যে সিরিয়াসলি পাক-অধিকৃত কারাকোরামে যাওয়ার দুঃসাহস করেছে! তবে ভারতীয় হিসেবে প্রায় অসম্ভব জেনে তুমি নাকি খুব লড়ছিলে নেপালের নাগরিকত্ব পাওয়ার। বিশ্বনাগরিক ছিলেই তুমি, আলাদা করে নেপালের নাগরিক নাই বা হলে! জানি না, মাকালু শিখর থেকে নামতে নামতে তুমি পৃথিবীর দ্বিতীয় শীর্ষের কথা ভাবছিলে কিনা। সেই ভাবনাতেই কি ক্লাসিক ছবির ফ্রিজশটের মতো বন্দী হয়ে গেলে মাকালুর সামিট শিরায়?

তোমার শেরপা বন্ধু ছেড়ে গিয়েছিল কেন? অনেক প্রশ্ন উত্তর পায়নি, অতীতে পায়নি, আজও পায় না। শেরপাদের প্রতি তোমার ভরসা ভালোবাসা বন্ধুতার এতটুকু কম পড়েনি কোনওদিন। শেষদিনেও কি তার বদল হয়েছিল। যদিও এর আগে শেরপারা তোমার নানা দুর্বিপাকের কারণ হয়েছে। প্রথম মাকালু অভিযানে তাই অভিজ্ঞতা। অনুরূপ কারণে কতজনকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। তবু ওদের প্রতি তোমার বিশ্বাস হারায়নি কখনও। কারণ, তুমিই দেখেছো একজন শেরপা কেমন পিতার মতো আগলে রাখে তার ক্লায়েন্ট আরোহীকে। চরম সঙ্কট মুহূর্তে নিজের অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেয় তার সঙ্গীকে, সামর্থের তলানিতে গেলেও সঙ্গীকে চোখ ছাড়া করতে চায় না। অবশ্য একান্তে তুমি এও মেনেছো যে শেরপাদের অনেকে আজ স্বধর্ম থেকে সরে গেছে। এই যে সেদিন, যে তুমি বার বার হাত বাড়িয়ে দিতে, তোমার দিকে একটি হাতও এগিয়ে আসেনি! আসলে জীবন বুঝি এরকমই। কত কী এসে যায় অযাচিতভাবে, আবার শতবার চেয়েও মেলে না কিছু!

একবার শীতের শিবিরের গল্পে ফিরি। আমাদের যত গল্প, যত স্বপ্ন-চিন্তা সব ওই ক্লাইম্বিং কোর্সের দিনগুলিতেই হতো সবচেয়ে বেশি। বিশেষত ক্যাম্পফায়ারে রাতে যে আসর বসতো, আগেই বলেছি, সেখানে সংস্কৃতির এক অনন্য আবহ সৃষ্টি হতো। সেখানে তোমাদের বিখ্যাত কোরাস ‘সুরাঙ্গিনি সুরাঙ্গিনি.., ইফ ইউ ওয়ান্ট টু ম্যারি মি ডিয়ার…’ ছাত্র-ছাত্রীরা আজও গানের কথা সুর খুঁজে হন্যে হয়। ওরা খুব খুব মিস করে। আমার একটা বিশেষ রাতের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। সে ছিল সেবারের ক্যাম্পফায়ার পর্বে শেষ গান – তুমি গাইছিলে —
‘মাঝিরে তোর নাম জানি নে, আমি ডাক দিমু কারে…মন তরে কেবা পার করে…’ তখন নিতান্তই তরুণ তুমি, অথচ কী অদ্ভুত বিষাদনন্দিত কন্ঠে ঝরে পড়ছিল এক আকুল প্রাণের লিপি! সেদিন শাল-মহুয়ার বনমহলে এক যুবক দরবেশ সুরে সুরে মাতোয়ারা অলীক একটি রাত উপহার দিয়েছিল আমাদের।
কেন ওই বয়সে তুমি অমন নিবেদিত প্রাণে গাইছিলে, কান্দিয়া আকুল হইলাম ভবনদীর পাড়ে…’ সেদিন বুঝিনি। আজ খানিক বুঝি। আধ্যাত্মচেতনা ছিল তোমার অন্তর্গত প্রবাহে, তার থেকেই বুঝি গড়ে উঠছিল এক মরমিয়া জীবনদর্শন। ভবনদীর পাড়ে সে থেমে থাকেনি, ভবসাগরের দিকে তার যাওয়া ছিল নিরন্তর। এদিকে আমি প্রায় বিপরীত পথের লোক, তবু ওই সুর আমায় ছেড়ে যায়নি। যাবেই বা কী করে? সেবারে ফেরার সময় রেলের কামরায় বসে গুনগুন করছিলাম গানটি। উল্টো দিকে বসে তুমি বললে, ‘সুর লাগছে না।’ আমি বললাম, ‘শিখিয়ে দাও।’ ব্যাস, শুরু হ’ল বুড়ো খোকাদের কাণ্ড!
দীপঙ্কর, আমি জানি না, তুমি মাঝির নাম জেনেছিলে কিনা। আমি এটুকু জানি আমার দেখা মানুষদের মধ্যে হয়তো তুমিই সবচেয়ে বেশি বেঁচেছিলে। বয়সকাল দিয়ে মাপা যায় না সেই বাঁচা। যে মানুষ জীবনে এতটা সময় মহাবিশ্বের মহাকাশে অপার বিস্ময়বোধ নিয়ে হেঁটে গেছে, তার কাছে মাঝি নিজেই এসেছে মহাকালের নৌকা বেয়ে!

মাত্র একবার সুযোগ পেয়েছিলাম সম্বর্ধনা দেবার, সোনারপুর বইমেলায়। সম্মাননা মঞ্চে উঠে তুমি বলেছিলে, ‘যে ছিল সবার নীচে (এভারেস্ট), সমুদ্রের গভীরতম দেশে, সেটি উঠে এলো সবার ওপরে! এর চাইতে আশ্চর্যকথা কী আছে?’ সত্যিই তাই। এর চেয়ে বড় আশ্চর্যকথা কী আছে! তুমি যতবার শীর্ষে পৌঁছেছ, সেই আশ্চর্যকথার সমুদ্রে নিজেকে আবিস্কার করেছো এক স্থির তরঙ্গের তুঙ্গ মুহূর্তে! এবং বার বার সেই মুহূর্তেই যেতে চেয়েছ তুমি। মেঘ পর্বতের মহাসাগরের বিপূল তরঙ্গশিরে একলা দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবে মাঝির নাম। সেখানেই রয়ে গেলে! মাঝি তার নাম বলেনি এতদিন। এবারে কি বলবে? হয়তো বলবে। যদি বলে, তুমি কি সেকথা জানাতে পারবে…, দীপঙ্কর…?

কিভাবে যাবেনঃ শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার জীপে বা বাসে পেলিং, পেলিং থেকে ছোট গাড়ী ভাড়া করে ইয়াকসাম।

কোথায় থাকবেনঃ পেলিং-এর আপার হেলিপ্যাড গ্রাউন্ডে প্রচুর হোটেল আছে,সেখানে থাকাই ভালো। কারন এখান থেকেই কাঞ্চনজংঘা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।ইয়াকসোমে থাকার জন্য রয়েছে প্রচুর হোটেল/হোমস্টে।

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!