হিমেল হাওয়ায় ইয়াকসোম : শ্রাবন্তী পোদ্দার

হিমেল হাওয়ায় ইয়াকসোম : শ্রাবন্তী পোদ্দার
হিমেল হাওয়ায় ইয়াকসোম : শ্রাবন্তী পোদ্দার

সিকিম রাজের প্রথম রাজধানী ছিল ইয়াকসোম, যেখানে তিব্বত থেকে গোচা গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে আসা তিন-লামার পৌরহিত্যে প্রথম রাজার অভিষেক হয়েছিল। এখন পর্যটক পদযাত্রীদের কাছে ইয়াকসোমের ভিন্ন গুরুত্ব। কারণ, এটিই কাঞ্চনজঙ্ঘার অন্দরমহলে যাবার গেটওয়ে। একাধিক দীর্ঘ রোমাঞ্চকর পথের শুরু এখান থেকেই। আজকের পদযাত্রীদের মধ্যে শ্রাবন্তী বেশ পরিচিত একটি নাম। দারুণ ছবি তোলেন তিনি। ছোট্ট লেখাতে ইয়াকসোমের ছবিই তুলে ধরেছেন, শ্রাবন্তী পোদ্দার

২৫ ডিসেম্বর সকাল। কফি আর কেক সহযোগে প্রাতঃরাশ সারতে সারতে মনটা যেন কোনও পাহাড়ে হারিয়ে গেল। মনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিরে পাহাড় যাবি? মন সাড়া দিল।যা কথা তাই কাজ, উপায় নেই, তৎকাল টিকিটই ভরসা। বছরের প্রথম সকাল দেখব কাঞ্চনজংঘার সাথেই। সেইমতোস্যাক, ন্যাপস্যাক গুছিয়ে প্রস্তুতি শুরু। ৩০ ডিসেম্বর রাতে শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেলে উঠে পড়লাম। পরদিন সকাল ৯ টায় নিউ-জলপাইগুড়ি। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা লুচি আলুরদম সহযোগে জলযোগ সেরে পেলিংগামী শেয়ার জীপে বসে পড়লাম,গন্তব্য পশ্চিম সিকিমের“ইয়াকসোম”।শেয়ার জীপের চাকা গড়াল। একে একে পার হয়ে এলাম সেবক, করোনেশন ব্রিজ, তিস্তা বাজার, মেল্লি বাজার। জোরথাং-এ এসে গাড়ী কিছুক্ষণ থামল। ৩০মিনিটের চা-পানের বিরতি। এবার গাড়ির চাকা গড়াল সোজা গেজিং হয়ে পেলিং-এর উদ্দেশ্যে। যখন পেলিং পৌঁছলাম তখন কাঞ্চনজংঘা গোধুলির আলোয় মাখামাখি।লটবহর নিয়ে উঠলাম হোটেল ‘সিম্বো’-তে। সেই দিনটা ছিল ৩১ ডিসেম্বর, অর্থাৎ বছরের শেষ দিন। উপরি পাওনা হিসাবে ছিল ক্যাম্পফায়ার, ডিজে, খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন। বর্ষবরণের আনন্দ নিয়ে নতুন এক ভোরের আশায় রইলাম। ০১ জানুয়ারী বছরের প্রথম দিন, ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটে, হোটেলের বারান্দায় ক্যামেরা, ট্রাইপড নিয়ে রেডি হচ্ছি ভোরের কাঞ্চনজংঘা দেখব বলে। দেখলামও তাই। সে এক অপূর্ব শোভা, যা লেখায় বা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ভোর সাতটা অবধি চললো আমাদের “ফটোশুট”। যেখানে প্রধান মডেল ছিলো “মাউন্ট কাঞ্চনজংঘা”।

মাউন্ট কাঞ্চনজংঘা
মাউন্ট কাঞ্চনজংঘা

মাউন্ট কাঞ্চনজংঘা
মাউন্ট কাঞ্চনজংঘা

সকাল সাড়ে আটটায় জলযোগ-পর্ব সেরে পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ইয়াকসোমের পথে রওনা দিলাম।রাস্তার দুধারে সবুজ আরও ঘন। নাম না জানা পাখিরা এখানে আপন মনেকথা বলে। আছে পথের ধারে উপচে পড়া সুন্দরী ঝর্ণা। একে একে দেখতে দেখতে এলাম রিম্বি ফল্‌স, অরেঞ্জ গার্ডেন, খেচিপেরি লেক, কাঞ্চনজংঘা ফল্‌স। এরপর এসে পৌছালাম একদা সিকিমের রাজধানী ইয়াকসোম। এখানে উচ্চতা খানিকটা বেশী হওয়ায়প্রকৃতির রূপও ভিন্ন। চোখ বুলিয়ে ঠাহর করা গেল ইয়াকসোমের পাহাড়ী গ্রামীণ চালচিত্র। চোখ জুড়ানো পর্বতশ্রেণী, হিমেল হাওয়ায় উড়ন্ত প্রার্থনা-পতাকা, ঝর্ণা, কমলালেবুর বাগান, স্থির জলের লেক, বৌদ্ধ গুম্ফা -স্বাগত জানালো ইয়াকসোম।

ইয়াকসোম
ইয়াকসোম

ইয়াকসোম একদা সিকিমের রাজধানী হওয়ায় এর গুরুত্ব অনেকটাই বেশি।১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে সিকিমের বৌদ্ধ মন্দির তৈরি হয় এখানেই। পুরাতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ডে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম এটি সিকিমের প্রাচীনতম গ্রাম। বর্তমানে ইয়াকসোমঅনেকতারাখচিত হোটেলে সমৃদ্ধ। বহু দেশী, বিদেশী পর্য়টক কাঞ্চনজংঘার টানে আসে এখানেই। এখান থেকেই শুরু হয় জোংরি গোচা-লা’র ট্রেক-রুটটি। অপূর্ব সুন্দর এই পাহাড়ী গ্রামটি যেন মনকে ছুঁয়ে যায়। এখানে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে পায়ে পায়ে হেঁটে দেখলাম – নরবুগাং চোর্তেন, নরবুগাং মনাষ্ট্রি, কাম্বোক গুম্ফা, ছোট বড় নানা প্রজাতির মাছে ভরা কাথোক লেক। দেখে আসলাম জোংরি হয়ে গোচালার ট্রেকরুটটিও।

মনকে আবারও বললাম- ফিরে আসবো এই পথে কাঞ্চনজংঘাকে দেখব বলে। তখন আমাদের গন্তব্য হবে “জোংরি হয়ে গোচালা”। এরপর ইয়াকসোমের মধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম পেলিং। সেইরাত পেলিং-এ থেকে সকালে কাঞ্চনজংঘাকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম ইট, কাঠ, পাথরে মোড়া নিজের শহরে। হৃদয়ে থাকল হিমেল পাহাড়ী গ্রামের স্মৃতি…ইয়াকসোম।

কিভাবে যাবেনঃ শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার জীপে বা বাসে পেলিং, পেলিং থেকে ছোট গাড়ী ভাড়া করে ইয়াকসাম।

কোথায় থাকবেনঃ পেলিং-এর আপার হেলিপ্যাড গ্রাউন্ডে প্রচুর হোটেল আছে,সেখানে থাকাই ভালো। কারন এখান থেকেই কাঞ্চনজংঘা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।ইয়াকসোমে থাকার জন্য রয়েছে প্রচুর হোটেল/হোমস্টে।

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!