বিপ্লবদা – আমাদেরই লোক : রুদ্রপ্রসাদ হালদার

বিপ্লবদা - আমাদেরই লোক : রুদ্রপ্রসাদ হালদার
বিপ্লবদা - আমাদেরই লোক : রুদ্রপ্রসাদ হালদার

তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট সামিট ছুঁয়ে আসা বিপ্লব বৈদ্য পর্বতারোহীর তকমা চায়নি কোনওদিন। কিন্তু মনে প্রাণে যাপনে সে ছিল প্রকৃত অভিযাত্রী। পৌঁছনো নয়, যাওয়াই ছিল বড় কথা। এবছরই কাঞ্চনজঙ্ঘা শীর্ষ ছুঁয়ে ফেরার সময় সে বরাবরের মতো হিমালয়ে সমাহিত হয়। বন্ধু পরিবার পরিজনের কাছে আর ফিরে আসেনি সে।
এখানে বিপ্লবের স্মৃতিচারণা করছে, তার অন্তঃ পর্বের সহযাত্রী রুদ্র প্রসাদ হালদার।

”মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক
আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়
এই হোক শেষ পরিচয়।”
                        –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-
২০১৭ তে কুন্তল কাঁড়ার তখন সবেমাত্র এভারেস্ট ক্লাইম্ব করে ফিরেছে। সাফল্যের উচ্ছ্বাস তখনও এতটুকু ফিকে হয়ে যায় নি। হাওড়াতে কুন্তলের বন্ধুরা সাকসেস সেলিব্রেট করার জন্য বিশাল এক ভোজসভার আয়োজন করেছে। কুন্তলের কাছের পর্বতারোহীরা সবাই উপস্থিত সেখানে। মলয় মুখার্জী, সত্যরূপ সিদ্ধান্ত, দেবাশিষ বিশ্বাস থেকে আরম্ভ করে বহু আরোহী ও পাহাড়প্রেমী মানুষের উজ্বল উপস্থিতিতে জমজমাট সে আসর। সেখানেই প্রথম আলাপ বিপ্লবদার (বিপ্লব বৈদ্য) সঙ্গে।
২০১৪ সালের ২৫ মে সবাইকে অবাক করে বিপ্লবদা, দেবব্রত মুখার্জীর সঙ্গে চীনের দিক (নর্থ কল) থেকে প্রথম অসামরিক বাঙালী হিসাবে এভারেস্ট আরোহণ করে হইচই ফেলে দেয়। কিছু পাহাড়প্রেমী মানুষ বিপ্লবদাকে চিনতেন। কিন্তু অনেকেই চিনতেন না। আমি ছিলাম সেই দলে। ২০১৫-য় নেপালে ভূমিকম্পের পর সেবছরের এভারেস্ট অভিযান বাতিল হলে কাঠমান্ডু ফিরে বিপ্লবদার সাথে প্রথম দেখা। অল্প পরিসরে প্রথম দেখাতেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন বিপ্লবদা আরোহণে কম যায়। কিছুটা সময় নিয়ে শান্ত স্বরে বিপ্লবদা জবাব দিয়েছিল, ‘কেউ আমাকে মাউন্টেনীয়ার বলুক তা আমি চাই না। আমি নেহাতই পাহাড়প্রেমী সাধারণ মানুষ। পাহাড় ভালোবাসি, তাই যাই। পর্বতারোহীর তকমা পরবার ইচ্ছে আমার নেই রে ভাই।’ উত্তর দিক থেকে এভারেস্ট ক্লাইম্ব করা, ট্রেলস পাস ও চৌখাম্বা কলের মতো দুরূহ সব ক্লাইম্ব যে করছে তার মুখ থেকে ঐ সব শুনে প্রচার-বিমুখ মানুষটার প্রেমে পড়ে যাই।
 হিন্দু স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ার সময় প্রথম পাহাড়ে ট্রেকিং করে বিপ্লবদা। আরো একটু বড় হয়ে যাদবপুরে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকে পাহাড় নিয়ে পাগলামি শুরু হয়। সেই থেকে গত ২৯ বছর ধরে পাহাড়ের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে। যাওয়ায় জায়গা নিয়ে কোন বাছবিচার করেনি কোনদিনই। আর ভাবুনতো একবার, বিপ্লবদার মতো একজন চলে যাচ্ছে অমরনাথ , বদ্রীনাথ, কুম্ভমেলায়! বেশ কিছু কোষ্টাল ট্রেক , আইএএফ’র পরিচালনায় পর্বতাভিযান , ক্লাবগত এক্সপিডিশন আর অসংখ্য ট্রেকিং নিয়েই বিপ্লবদা মজে ছিল। বছরে দু’একবার প্রকৃতির কোলে ঠিক পৌঁছে যেত।  মোটকথা পাহাড় হলেই চলবে। পাহাড় মানে বিপ্লবদার কাছে শান্তির ঠিকানা। অসংখ্য ট্রেকিং অভিযান করতে গিয়ে হিমালয়ের গাছপালা, মানুষজন ও প্রকৃতির সাথে একটা অসাধারণ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। জ্ঞানের ঝুলিটিও ভরে উঠেছিল তাঁর।
সেবার সময়ের অভাবে আলাপ না জমলেও কুন্তলের ঐ আসরে গল্পে গল্পে রাজি হয়ে গেল ‘সোনারপুর আরোহী’ র সেবছরের অভিযান ‘গৌতম পর্বতে’ আমাদের সঙ্গী হতে। অভিযানটি ছিল অনুসন্ধানমূলক। সেই শুরু। তারপর থেকে আরোহীর প্রতিটি ভেঞ্চারে বিপ্লবদা বড় দাদার মতো সবাইকে আগলে নিয়ে চলেছে। যে মানুষটা তার পাহাড়জীবনের ২৭ বছর সংগঠন এড়িয়ে চলেছে, সে ২০১৭ থেকে হঠাৎ করে জমে গেল ‘আরোহী’তে। কেন জানি না। তবে বুঝেছি আমরা যারা সোনারপুর আরোহীর নানা কর্মকান্ড নিয়ে মেতে থাকি , তাদেরকে বা তাদের উদ্যেশ্য হয়তো ওঁর ভালো লেগেছিল! এবারের কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে গিয়ে একদিন কথায় কথায় বলেছিল, ‘রুদ্র তুমি পরে ৮০০০ মিটার কোন সামিটে যাও তো যাবে। আমি ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে প্রতিবছরই অভিযানে বেরোব।’  নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের সবসময় উৎসাহ দিত। আর ছিল এক্সপ্লোর করার প্রবনতা। পিক ক্লাইম্ব করার থেকে বেশী পছন্দ করত নতুন নতুন জায়গার খোঁজখবর নিয়ে আগামী দিনের আরোহীদের সামনে নতুন পথ নতুন তথ্য দিয়ে যেতে। পিক ক্লাইম্ব করার কোনো বিশেষ  প্রবনতা ছিলনা। গতবছর মূলকিলাতে সামিট ক্যাম্প থেকে বেড়িয়ে সারারাত ধরে একটা পাঁচশ মিটারের বরফের খাড়াই দেওয়াল ক্লাইম্ব করে সকাল দশটাতে সামিটের খুব কাছে পৌছে গেছি। পরিস্থিতি অনুযায়ী ধরেই নিয়েছি, আর আধ ঘন্টার মধ্যে মূলকিলা ধরা দেবে। আমরাও মনেপ্রাণে চাঙ্গা আছি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে বিপ্লবদা বলে দিল আর এগোবেনা। পার্থদা (পার্থ সারথি লায়েক) উৎসাহিত করতে গেলে বলেই দিল, ‘আর যাব না। মুলকিলার বুকে আমার নাক ঘষা হয়ে গেছে।’ এত নিশ্চিত কাছে এসে বিপ্লবদাই পারতো , লক্ষ্য ছেড়ে দিতে। ওর কাছে পাহাড় উপভোগ করাটাই প্রাধান্য পেয়েছে বরাবর। ‘ক্লাইম্বিং ফর হ্যাপিনেস’।
 আবার যখন দলের কোন প্রয়োজন পড়ে যত কষ্টই হোক বিপ্লবদা সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিত। শুধু পাহাড়ে নয় , সব জায়গাতেই বিপ্লবদা ঐ একইরকম। শীতের রাতে কম্বল নিয়ে একা বেড়িয়ে পড়তো কলকাতার রাস্তায় , ফুটপাতে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে চলে যেত। নিজের সামর্থমতো পাশে দাঁড়াতো, মানুষের পাশে। মানুষটার গ্রহণযোগ্যতা ছিল দেখার মত। সে নিজের বাড়ির লোক হোক, স্কুল কলেজের বন্ধু হোক, অফিসের কলিগ হোক আর নিজের পাহাড়জগতের মানুষ হোক – বিপ্লবদা সবার কাছের মানুষ। খুব স্পষ্ট বক্তা। যেটা খারাপ মনে হতো সেটা মুখের উপর বলে দিতে পিছপা হয়নি কখনও।
বিপ্লবদা সঙ্গে থাকলে অভিযানে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা হবে না কোনওদিন। ভীষণ রান্না করতে ভালবাসত। আর মনেপ্রাণে মজলিসি মানুষ। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে পারাটাই নিজের শান্তি ভাবত।  প্রায়ই একটা গান গাইত গুনগুনিয়ে। জামাইকান ফেয়ার ওয়েলের সেই বিখ্যাত গানটা।
 আহা পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়
 যেথা সময় থমকে থামে বটের ছায়। 
   আহা সন্ধ্যা দীপ জ্বালে তারার টিপ 
 কত ফুলের গন্ধে মোর মন মাতায়।
   হায় কোন সুদূর সেই স্বপ্নপুর
   মোর মন যে চায় ঘরে ফেরার সুর…. 
বিপ্লবদার আর ঘরে ফেরা হয়নি। রয়ে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘার ভয়ঙ্কর সুন্দর নীল বরফের রাজ্যে। ওঁর নিজস্ব পৃথিবীতে,চাওয়াপাওয়ার শান্তির ঠিকানায়। তাঁর নশ্বর দেহটা ফিরে এলো নিতান্ত জাগতিক প্রয়োজনে। না, বিপ্লবদার কোন ক্ষতি হয়নি। সে তাঁর স্বপ্নের ঠিকানাতেই রয়ে গেল। হ্যাঁ, কাছের মানুষদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। তবে রয়ে গেল ওঁর স্বপ্ন। আমরা সেই স্বপ্নগুলোকে বুকে নিয়ে চলতে থাকবো, যতদূর যাওয়া যায়। স্বপ্ন তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না!
শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!