সম্পাদকের কলমে

অরুণকান্তি ঘোষ, সম্পাদক, আরোহী e-ম্যাগ
অরুণকান্তি ঘোষ, সম্পাদক, আরোহী e-ম্যাগ

‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’ – কবি বলেছিলেন বহুবছর আগে। সে অসুখ আজও সারেনি, বরং ক্রমশই আরোগ্যের সীমানা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ সচেতন মানুষও বুঝছেন যে, এই পৃথিবীর জল জঙ্গল নদী সাগর পর্বত জনপদ প্রতিকারহীন দূষণের শিকার। আকাশ বাতাসও সে অসুখের কবল থেকে ছাড় পায়নি। মানুষ নিশ্চন্তে শ্বাস নিতে পারছে না, পানের জন্য নিরাপদ জল খুঁজে হয়রান হচ্ছে। তবু জগতের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহটি ছেড়ে কোথায় যাবো আমরা? একদিন অভিযাত্রীরা এর প্রত্যন্ত প্রান্তের সন্ধান দিয়েছিল, সাধারণেরা যে যার বাসভূমি খুঁজে নিয়েছিল, ক্রমে গ্রামগঞ্জ নগর বন্দর দেশ মহাদেশ গড়ে উঠেছিল। সভ্যতার জয়যাত্রা সূচিত হয়েছিল ইতিহাসের নিয়মে। ওই নিয়মের মধ্যেই কি ভুল ছিল কোথাও? হ্যাঁ, ছিল। নইলে সৌরজগতের সুন্দরতম গ্রহের সর্বত্র জবরদখল জারি থাকবে কেন? ভাবলে শিউরে উঠতে হয়, দূরদুর্গমে প্রকৃতির একান্ত সুরক্ষিত অঞ্চলে রেললাইন পেতে ফেলেছে, সড়কপথ ছুটিয়ে দিয়েছে, দানবীয় স্থাপত্য গড়ে তুলেছে, এই মানুষ! সভ্যতার কী প্রবল ও সীমাহীন ঔদ্ধত্য! আজ আমাজন পুড়ছে। দেশেদেশে বিস্তীর্ণ বনভূমি সাফ করে মুনাফার সন্ধান চলছে। পৃথিবীটা যেন নিয়তি-নির্দিষ্টমতে আরোগ্য সম্ভবনার বাইরে চলে যাচ্ছে। সুখের কথা, এখনও অগণন সচেতন, শুভস্বপ্ন দেখা সাধারণ জন আছে, বিশেষত অভিযাত্রীরা আছে, যারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে জেহাদ জারি করা এই সভ্যতাকে মানে না। তারা এর বিরুদ্ধে কাজ করে যায়। কারণ, তারা জানে, ‘মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে!’ তাই দায় আছে।

আজ দূষণমুক্ত বিশ্বের জন্য আওয়াজ উঠেছে সবখানে। অসম হলেও লড়াই কিন্তু জারি আছে। এবং সেই লড়াইয়ে অনেকের সাথে শরিক হয়েছে ‘সোনারপুর আরোহী’। আরোহীর তরুণরা কাজ করছে। অতিসম্প্রতি ওরা বকখালি-ফ্রেজারগঞ্জ এলাকায় ইস্কুলে পথপাশে জমায়েত করে, সমুদ্রতীরে হেঁটে পরিবেশরক্ষা, বনসৃজন, প্লাস্টিক বর্জন, ইত্যাদি বিষয়ে হাতেকলমে কাজ করে এসেছে। এতে যেটূকু সাড়া পাওয়া গেছে, সুফল মিলেছে – তাতে আমরা যথেষ্ট অনুপ্রাণিত, অভিভূত। অবশ্য বিষয় এখানে থেমে থাকলে চলবে না। এমন কাজ ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যেতে হবে, যা একদিন সর্বজনের গণ-আন্দোলনের রূপ নেবে। হ্যাঁ, এটাই সম্ভাব্য মুক্তির পথ। এছাড়া অভিযাত্রীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য আরোহীর যা কিছু চিন্তা ও উদ্যোগ, সে-তো চলবেই। এবছরে বাঙলা থেকে অভিযানের ক্ষেত্রে বড় মাপের কাজ হয়েছে, আবার এবছরেই বড় ট্রাজিক অধ্যায়ের সাক্ষী হতে হয়েছে আমাদের। অভিযান হয়েছে এভারেস্ট, কাঞ্চজঙ্ঘা, লোথসে বা মাকালু শিখরে। এক কাঞ্চনজঙ্ঘার স্বর্ণশিরে পা রেখেছে রুদ্র, রমেশ, বিপ্লব, সাহাবুদ্দিন। রুদ্র ও বিপ্লব আরোহীর অভিযাত্রী। এক বছরে এত সাফল্যের নজির শেষ কবে দেখেছি, মনে পড়ে না। তবু এই সাফল্যের আনন্দ, খুশির নির্ঝর, সব চাপা পড়ে গেল অপ্রত্যাশিতের আঘাতে।

এই বছর ৩ এপ্রিল সোনারপুর মোড়ের সন্ধের ছবিটা বারবার মনে পড়ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে রওনা দেওয়ার ঠিক আগে রুদ্রপ্রসাদ (হালদার) ও বিপ্লবকে (বৈদ্য) আগাম অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানোর প্রতীকী ‘ফ্ল্যাগ অফ’ পর্বটি ছিল ওই সন্ধেয়। বন্ধু সহযাত্রী পথচলতি মানুষ ও অভিযান-প্রেমীদের স্বতঃস্ফুর্ত ওই সমাবেশ যেন নিশ্চিত করেছিল স্বর্ণশিখরের সাফল্য। মনে পড়ছে রুদ্র এবং বিপ্লব দুজনেই এক বিখ্যাত আরোহীর সংলাপ উধৃত করেছিল আলাদা শব্দবন্ধে, কিন্তু একই সুরে – ‘চূড়োয় পা রাখা না রাখা তোমার পছন্দের ব্যাপার, কিন্তু নেমে আসাটা (ফিরে আসা!) বাধ্যতামূলক।’ ফিরে আসা যে কোনও অভিযানের পূর্বশর্ত। ট্রাজেডি এই যে, কোনও অভিযানই যাবতীয় শর্ত মেনে চলে না, চলতে পারে না। এক্ষেত্রেও পারেনি। রুদ্র ফিরেছে, বিপ্লব ফেরেনি। রমেশ সাহাবুদ্দিনরা ফিরেছে, কুন্তল দীপঙ্কর ফেরেনি। দীপঙ্করের মতো অভিজ্ঞ, পরিণত, সাহসী অথচ স্থিতধী আরোহীকে তার সফল মাকালু অভিযান (দ্বিতীয় প্রয়াস) শেষে ফেরার পথে হার মানতে হ’ল প্রকৃতির ঘাতকীয় খেয়ালের কাছে। এক মহাকাব্যিক চরিত্রের এমন করুণ পরিণতি আরোহণের ইতিহাসে আগেও ঘটেছে, আজও ঘটছে। অপূরণীয় ক্ষতি। তবু দীপঙ্করেরা চলে গিয়েও এই বার্তা দিয়ে গেছে বার বার, অভিযান থেমে থাকার নয়। আজ ও আগামীর অভিযাত্রীরা এ সত্যকে ধ্রুব জেনে দুর্গমের অভিসারে পাড়ি দেয়, পাড়ি দেবে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আরোহীর বাত্সরিক মুখপত্র প্রকাশিত হ’ল ওয়েব-আকাশে, যে আকাশ সকলের হাতের তালুতে ধরা দেয়। আমাদের বেশ ক’জন বিশিষ্ট বিদগ্ধ বন্ধুরা কলম ধরেছেন আরোহীর জন্য, তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। এবং যাঁরা লঘু গুরু নানা উপায়ে আমাদের পাশে রয়েছেন, সহযাত্রী হয়েছেন, তাঁদের সবার কাছে আমরা সততই ঋণী। এই যে অনেকের সঙ্গে একসাথে থাকা, এটাই সোনারপুর আরোহীর সব স্বপ্ন কর্ম দুঃসাহসের উত্স হয়ে থাক।

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!