কলকাতা টু কানামো : কল্যানাশীষ চৌধুরী

কলকাতা টু কানামো : কল্যানাশীষ চৌধুরী
কলকাতা টু কানামো : কল্যানাশীষ চৌধুরী

কাঁচড়াপাড়ার ‘দ্য নেচারস ফাউন্ডেশন’ আট থেকে ষাটের একটি দল নিয়ে স্পিতি’র মার্চিং পিক কানামোয় পদযাত্রা অভিযান সংগঠিত করেছিল গতবছর। তার উপভোগ্য বিবরণ দিয়েছেন, কল্যানাশীষ চৌধুরী

বাইরে বিরামহীন বৃষ্টি। আমরা ‘দি নেচারস ফাউন্ডেশন’ এর কয়েকজন সদস্যএক বৈঠকখানায় চপের বাটিতে আক্রমণ শানাতে শানাতে সিকিম থেকে হিমাচলের বিভিন্ন রুট নিয়ে চুলচেরা চুলোচুলি করছি। কারণ এই বছরের অভিযানে আমাদের যে টিম তৈরী হতে চলেছে,  সেই টিমে ৮ বছরের বালিকা থেকে দুইজন মহিলা সহ ৬০ বছরের বালক অবধি অংশগ্রহণ করবে। সেই আলোচনার কল্যাণেই আমাদের এই বছরের অভিযান ঠিক হলো ‘কানামো’। যাকে ইংরাজিতে তর্জমা করলে দাঁড়ায়  ‘দি হোয়াইট লেডি’, উচ্চতা ১৯৬০০ ফুট, অবস্থান সেন্ট্রাল স্পিতি, হিমাচল প্রদেশ। এর আগে ২০০০ সালে কাজা, কিব্বের, পারাংলা পেরিয়ে সো-মোরারির পার ধরে কোরজোক অবধি গিয়েছিলাম।   প্রকৃতির বাড়াবাড়িপনাটা এখানে খুবই উপভোগ্য। সেই স্মৃতিকে উস্কে দিয়েই এবার সপরিবারে পরিপাটি পদযাত্রার পরিকল্পনা, সাথে সুন্দর একটা শৃঙ্গজয়ের স্বপ্ন।

অবশেষে প্ল্যান ঠিক হল, কাঁচড়াপাড়া থেকে যাত্রা শুরু হবে ১১ই আগস্ট ২০১৮। এরপরই প্রথমে রেলের টিকিট কাটা, আইএমএফ কে চিঠি লেখা, অফিসের কাছে অনুমতি চাওয়া, পাশাপাশি ছুটির দরখাস্ত, রেশনের লিস্ট তৈরি, তাঁবুইউটেন্সিলস্ পরিষ্কার শুরু হয়ে গেল।দিন ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকলো, মনের মধ্যে উত্তেজনা ও আনন্দের অদ্ভুত মিশেল। অবশেষে পূর্বনির্ধারিত সময়ে দি নেচার্স্ ফাউন্ডেশনের ছোট্ট দলটি কাঁচরাপাড়া থেকে রওনা দিল। দলে চার জন পুরুষ সদস্য যাদের মধ্যে সবচেয়ে খোকা আমি, বয়স মাত্র ৪৩ আর সবচাইতে বুড়ো সন্তোষদা, যার বয়স ৬০ ছাড়িয়েছে। বাকি যে চারজন মহিলা সদস্য তাদের বয়স যথাক্রমে ৮,৯ এবং…? বাকি মহিলাদের বয়স বলতে নেই, ওটা ধ্রুবক !

হাওড়ার ৯নং প্ল্যাটফর্ম থেকে ঠিক ৭-৪০ মিনিটে ১২৩১১ আপ কালকা মেল ছাড়ল। তার আগে ক্লাবের সেক্রেটারি পুলকদা ক্লাবের ফ্ল্যাগ ও ন্যাশানল ফ্ল্যাগ তুলে দিলেন অভিযানে দলনেতা সন্তোষ দা’র হাতে, অনেক সদস্যের উপস্তিতিতে। ট্রেন ছাড়ার পর প্রচুর মালপত্র গুছিয়ে শান্ত হয়ে বসলাম।

ট্রেন হু হু করে ছুটে চলেছে কামারকুন্ডুমশাগ্রাম অন্ডাল। হাতের সামনে চলে এলোকষা মাংস,  ছোলে-তরকা, তন্দুরি রুটি ও মিষ্টি – যেন বিয়েবাড়ি…।  নাহ্, এতো মিষ্টি এক্সপিডিশন এর আগে, সত্যি বলছ, কোনদিন জোটেনি। এই এক্সপিডিশনে রস প্রচুর, কষ বরং কম।

পরদিনটা ট্রেনের মধ্যে গল্প করে আড্ডা দিয়ে বেশ ভালোই কাটলো। বর্ষাস্নাত উত্তর ভারতের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ক্রমশ ছুটে চলেছে চন্ডীগড় এর দিকে। চারদিকের সবুজ যেন বৃষ্টির পরে আরও সবুজ লাগছে, আর আমরা চলেছি ঊষর সবুজহীন ধূ ধূ প্রান্তর স্পিতিতে।  স্পিতি কথার অর্থ  হল ‘দ্য মিডল্ ল্যান্ড’ যার উত্তরে তিব্বত আর দক্ষিণে মূল ভারত ভূখন্ড।  মাঝে এই হিমশীতল শুষ্ক মরুভূমি,  ভারতের সবচাইতে কম জনঘনত্বের অঞ্চল যার গড় উচ্চতা ১২,৫০০ ফুট। এ যেন এক অন্য হিমালয়।  স্পিতি মানেই গভীর নীল আকাশে মেঘেদের ছুটোছুটি, তীব্র কনকনে ঠান্ডা হাওয়া, বৃষ্টিছায় প্রান্তর, অসংখ্য শৃঙ্গ, হিমবাহ, চোর্তেন আর গুরুগম্ভীর মোনাস্ট্রির ভিতর থেকে ভেসে আসা ড্রাম ও শিঙ্গা’র হুঙ্কার।

গতরাতে দিল্লি ছাড়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছি।  ১৩ই আগস্ট,  ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটে চন্ডীগড় স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালো। ভারতীয় রেলের এত সুন্দর পরিষেবা ভাবাই যায় না। একদম রাইট টাইম।  বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। চন্ডীগড় স্টেশনের টিনের চালা একেবারে কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে।  বৃষ্টির মধ্যেইঅটোয় মালপত্র চাপিয়ে চললাম বাসস্ট্যান্ড। ভোর সাড়ে চারটেয় বাস ছেড়েও দিল।  ভাবলাম সন্ধ্যে নামার আগেই মানালি পৌঁছে যাব। কিন্তু ভাবনা আর বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান।  ভুন্‌তারে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি, চারিদিকে ধস্, রাস্তা বন্ধ। বিলাসপুর থেকেই  গাড়ির লম্বা লাইন।একটা করে বাস বদল, একটু করে এগোনো আর ঘন্টার পর ঘন্টা প্রতীক্ষা।

আশেপাশে কোনো খাবারের দোকান বাপানীয়জলের ব্যবস্থা নেই। শিশু অভিযাত্রীদের প্রথমেই বেশ কড়াপরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হল।  সেই রাতটা নিকষ কালো অন্ধকারে আধপেটা খেয়ে বাসের মধ্যেই কাটালাম।  মাঝরাতে বিকট শব্দে বাসের পিছন দিয়ে একটা বড় ধস্, রাতের অন্ধকারে পাগলী বিপাসার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পরদিন দুপুর নাগাদ প্রায় ৩৪ ঘন্টা পরে লটবহর নিয়ে মানালির হোটেল শিবালিকে এসে উপস্থিত হলাম। সেখানে বলেই দিলো ট্রান্সফরমার বিকল হয়েছে,  তাই  মানালিতে জল এবং বিদ্যুৎ নেই।

১৫ তারিখ আমাদের দল দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি দল গেল হিড়িম্বা মন্দির, বশিষ্ঠ আশ্রমের দিকে। আর একটি দল গেল রেশন-বাজার, গাড়ি ঠিক করা, জ্বালানি যোগাড়, ফাইনাল স্যাক্ এবং গানি প্যাকিং ইত্যাদি নানা প্রয়োজনীয় কাজে। আজ মানালির আকাশএকদম পরিষ্কার। আগের দিন রাতেও আকাশে অনেক তারাছিল।

পরদিন খুব সকালে আমরা মানালি ছাড়লাম, গন্তব্য কাজা। দীর্ঘ অথচ ভীষণ সুন্দর এই পথ। সবুজ গালিচার মধ্য দিয়ে নিকষ কালো পিচের রাস্তা,  আশেপাশে দু-চারটি ঝর্ণা কে পিছনে ফেলে ওপরের দিকে উঠতে থাকলাম। এ অতি প্রাচীন পথ, বহু বছর ধরে তিব্বতীয় সভ্যতার সাথে বানিজ্য ও সংস্কৃতির আদান প্রদান করে চলেছে। পৌঁছালাম মারি, উচ্চতা ১১,১০০ ফুট।  এখানে চা-জলখাবারের সামান্য বিরতি। এরপর আমাদের রোটাং পাস পেরোতে হবে। গাড়ি আবার গোঁ গোঁ চিৎকার করে চড়াই ভাঙতে শুরু করলো।

রোটাং একটা পারসী শব্দ। যার ইংরেজি মানে করলে দাঁড়ায় “ভ্যালি অব ডেথ”। এটি অতিক্রম করতে গিয়ে আজ থেকে ১০০ বছর আগেও অতিরিক্ত ঠান্ডায়,  দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বা পথ হারিয়ে বহু মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে। আমরা উঠে এলাম রোটাং পাসের মাথায়, উচ্চতা ১৩,০৫১ ফুট। পেছনে পরে রইলো কুলু উপত্যকা। পাস থেকে নামতেই চলে এলাম গ্রামফু। সোজা রাস্তা চলে গেছে লে-র দিকে, আমরা যাবো ডান দিকে। চন্দ্রা নদীর ধার দিয়ে বড় বড় পাথর আর মাটির এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। গাড়িতে বসে মনে হলো যেন ভাইব্রেটর এ বসে আছি।  যাই হোক সবার ভুঁড়ি সামান্য হলেও কমবে। সকাল ৯-৩০ নাগাদ গাড়ি এসে থামলো ছত্রু, উচ্চতা ১৩১০০ ফুট। ১২০ জন লোকের বাস। চারদিকে কত রঙিন ফুল, চন্দ্রা নদীর বহতা রূপ আর হিমালয়। আমাদের কত রকমের প্রতিবন্ধকতা থাকে – কারও শারিরীক,  কারও বা আর্থিক,  কারও আবার সময়ের অভাব।  কিন্তু সব প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে বেরোনোর একটাই কারণ এই সৌন্দর্যের অমোঘ হাতছানি।

এর মধ্যে আমাদের এক সদস্যাঅসুস্থ হয়ে পড়েছিল। প্রচুর বমি করছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে ইনজেকশন দিতে হয়। ড্রাইভার সাহেবের তাড়া সত্বেও আমরা ছত্রুতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম।  বুঝতে পারছিলাম বেলা বাড়ার সাথে সাথে ছোটা ধারার জলের তোড় এতোটাই বেড়ে যাবে যে গাড়ি পার করায় খুবই অসুবিধা হবে, অগত্যা…।  পথে বেশ কিছু দেশি বিদেশি বাইকার চোখে পড়ল। আমরা যখন বাতাল এসে পৌঁছালাম তখন বেলা ১২টা। ওখানেই বৌদির হোটেলে খাবার সারলাম। বছর ১৬ আগে চন্দ্রভাগা-১৩ অভিযানে এসেও এই বৌদির হোটেলে লাঞ্চ সেরেছিলাম। ওখান থেকে ডান দিকে চন্দ্রানদীর ব্রীজ পেরিয়ে রাস্তা ওপরের দিকে উঠতে থাকল। পেছনে পরে রইলো বাতাল, দূরে  সেন্ট্রাল লায়ন শৃঙ্গ এবং আরও দূরে  পাপসুরা শৃঙ্গ। উঠে এলাম কুনজুম-লা’র মাথায়, উচ্চতা ১৫০৬০ ফুট।  কুনজুম-লা পেরিয়ে আসা মানেই লাহুল থেকে স্পিতি উপত্যকায় চলে আসা৷ পাসের থেকে সিবি-১৩ শৃঙ্গটিকে অসাধারণ লাগে। ২০০১ সালে এই পাহাড় চূড়ায় একবার উঠেছিলাম।

এরপরে হিমালয়ের চরিত্র আবার অন্যরকম, রাস্তা তুলনামূলক ভাবে অনেক ভাল। কিছু জায়গা বাদ দিলে মনে হবে যেন গড়ের মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে, দূরে পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন রঙ,  কোথাও লালচে, কোথাও সবজে রঙের ছোঁয়া। মনে হয় মিনারেলের কারনে এরকম হয়েছে।  এসে পৌঁছালাম স্পিতি উপত্যকার লোসার গ্রামে। এর আগে এত দীর্ঘ পথে মাত্র দুটো জন বসতি পেয়েছি  – কুলু উপত্যকায় কোটি, লাহুল উপত্যকায় ছত্রু,আর এখন লোসার। লোসার গ্রামটা আমার খুব ভালো লাগে। বিরামহীন ধূসরের মাঝে এক চিলতে সবুজ। প্রচুর মটরশুঁটি খেত, গমের শীষ।এখন এখানে প্রচুর হোমস্টে হয়েছে। গাড়ি আরও এগিয়ে চললো রুক্ষ থেকে রুক্ষতর হিমালয়ের দিকে। এ ভয়ঙ্কর ভয়াল অনাগ্র (যেখানে কোনো দিন ফসল হয়নি) পৃথিবী। তীব্র তীক্ষ্ণ হাওয়ার দাপটে পাহাড়কে কখনো দূর্গ মনে হয়,  কখনো মনে হয় সেই আদ্দিকালের ধ্বংসস্তুপ হয়ে যাওয়া জর্ডনের পেত্রাসভ্যতা। অবশেষে সন্ধ্যা নামার আগে দূরে দেখতে পেলাম কি মোনাস্ট্রি আর কিব্বের গ্রাম। আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়ালো বিশ্বের সর্বোচ্চ রিটেইল পেট্রল পাম্পে, আরে গাড়িটার তো খাদ্য খাবার দরকার!

১৯৯৯ সালে রূপসু ভ্যালির অভিযানের সময়ে দেখা কাজা’র সাথে আজকের কাজা-কে মেলাতেই পারলামনা। প্রচুর দোকান পাট, বসতিও বেড়ে গেছে,  গরমও যেন বেড়ে গেছে। বাজারের পাশে এক হোটেলে উঠলাম। টিক্কমরাম, সন্তোষ দা, সঞ্জয় দা বাজারে চলে গেল। আমি কাকলি দীপাআর বন-বাহাদুর রান্নার তদারকি করতে থাকলাম। পরদিন আমাদের জ্বালানি, রেশন, সবজি ইত্যাদি কেনাকাটার কাজেই ব্যস্ত থাকতে হল। অভিযান সেরে ফেরার পথে যেহেতু আমরা এই দিক দিয়ে ফিরবো না অর্থাৎ আমাদের ফেরাটা হবে টাবো, নাকো ও কিন্নর হয়ে সিমলা, সেইজন্য ফেরার গাড়ির ব্যাপারেও খানিকটা কথা পাকা করে রাখলাম।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলোএকটু দেরীতেই, জানলা থেকে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশ আর পিঙ্গল বর্ণের পাহাড়।  আকাশ একদম ক্লিয়ার, বেশ হাওয়া দিচ্ছে।  সকাল ১০-৩০ টার সময়ে দুটো গাড়ি এলো। একটা গাড়ি তে মালপত্র ব্যোমবাহাদুর ও লোকেশ, আর একটা গাড়িতে আমরা সবাই আর টিক্কমরাম।  মাত্র১৯ কিমি রাস্তা, কিন্তু এত অসাধারণ যে ভোলার নয়, গন্তব্য কিব্বের। যাওয়ার পথে ঐতিহাসিক কিমোনাস্ট্রিওঘুরে নিলাম।

কিব্বেরে আমরাদুটো দিন থাকবো। প্রথম কারন, এই ১৪৩০০ফুট উচ্চতার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়া। দ্বিতীয় কারণ, বেস ক্যাম্প অবধি মাল বহন করার জন্য যাবতীয় বন্দোবস্ত করা।  কিব্বের গ্রামটা অত্যন্ত সুন্দর, মানুষজন বেশ পরিবেশ সচেতন মনে হল।ক্ষেত খামারও প্রচুর আছে। ধান গমের পাশাপাশি প্রচুর মটরশুঁটি ক্ষেত।  সুন্দর মিষ্টি এই মটরশুঁটি। বছরের অর্ধেক সময় বরফে মোড়া থাকে এই কিব্বের। বাকি সময়ে চাষবাস আর পশুপালন। কিব্বের গ্রামের মাথার ওপরে একটা সুন্দর মোনাস্ট্রি আছে, আর আছে উত্তর পশ্চিমে বরফে মোড়া কানামো শৃঙ্গ।

এবার আমরা অভিযানের মূলপর্বে চলে এসেছি, আগামীকাল  আমাদের বেসক্যাম্প যাত্রা। ১৪৩০০ ফুট থেকে উঠে যাব ১৬৫০০ফুটে। এই অবধি সব ঠিকঠাকই চলছে, পরদিন অর্থাৎ ২০শে আগস্ট সকাল ৮-২০ তে আমরা কিব্বের থেকে বেসক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। গ্রাম পেরিয়ে আমরা ওপরের দিকে উঠে চলেছি, মাঝে কোথাও জলের যোগান নেই। আস্তে আস্তে সবুজ শেষ হয়ে গেল। অসমবয়সী অভিযাত্রীদল, কেউ ছোটো ছোটো পায়ে, কেউ বা লম্বা লম্বা পায়ে চড়াই ভাঙছে। সবার সাথেই সমন্বয় করে চলেছি। পথে পাথরের খাঁজে ভোরালের সাথে দেখা। খুদে অভিযাত্রীরাভোরাল দেখে,  মজা পেয়ে লাফালাফি শুরু করলো। বেশ কিছুটা এগিয়ে পেলাম কানামো লেক। এখানে ক্ষণিকের বিরতি। সেখান থেকে একটু দূরে একটা কুঁজের ওপর দেখা যাচ্ছে কানামো বেস-ক্যাম্প। এই অঞ্চলে প্রচুর জীবাশ্ম দেখা যায়। অবশেষে দুপুর দেড়টা নাগাদ আমরা সকলে বেসক্যাম্প এ পৌঁছলাম। বাচ্চারা তো দারুণ হাঁটল। বেশ হাওয়ার মধ্যে খান চারেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে টেন্টপিচ করা হল, একটু দূরে কিচেন টেন্ট, সামনেই সুন্দর জলের উৎস। লাঞ্চের পর মিটিং এ বসে ঠিক হল আগামীকাল রাত ৩-টেয় সামিটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু।

তারায়ভরা আকাশ। তারিখ ২১ আগস্ট,  সময়রাত্রি ২-৪৫ মিনিট। হিমেল অন্ধকারের বুক চিরেহেডটর্চ জ্বালিয়ে চললাম ‘দ্য নেচারস ফাউন্ডেশন’ এর চারজন সদস্য ও দুজন শেরপা।  লক্ষ্য কানামো শৃঙ্গ, উচ্চতা ১৯,৬০০ ফুট।  প্রথম আড়াই ঘন্টা সাধারণ চড়াই বেয়ে আমরা এক বিশাল মাঠের মধ্যে উপস্থিত হলাম। সেখানে ২০ মিনিটের বিশ্রাম।ফ্ল্যাস্কের গরমজলে টি-ব্যাগ ডুবিয়ে চা, বিস্কুট ও কিছু শুকনো খাবার জুটল। পুরো পথটাতে বিন্দুমাত্র জলের চিহ্ন নেই। পূবের আকাশ ক্রমে ফর্সা হয়ে আসছে এবার সামনে দুই থেকে আড়াই ঘন্টার কঠিন লম্বা চড়াই। এ চড়াইয়ের মাথাকে বলা হয় ছোটাকানামো। সকাল ৮টা নাগাদ ওই চড়াই এর মাথায় উঠে এলাম। খানিক বিশ্রাম। কিছু খাবারও জল রেখে দিয়ে এবার আমরা মূল কানামো শৃঙ্গের দক্ষিণ পশ্চিম গিরি শিরা ধরে প্রাণান্তকর চড়াই অতিক্রম করতে থাকলাম – পুরোটাই স্ক্রি-জোন।  তিন পা উঠি তো এক পা নামি – এ যেন তৈলাক্ত দন্ডে বাঁদরের ওঠা নামার অঙ্ক কষা।  সাড়ে দশটা নাগাদ প্রথম দেখতে পেলাম নীল আকাশ ও সাদা বরফের মাঝে চোর্তেন উঁকি দিচ্ছে।  বুঝতে পারলাম আমরা লক্ষ্যের খুব কাছে চলে এসেছি। বেলা পৌনে এগারোটা নাগাদ আমরা সামিট করলাম। দূরে মাউন্ট গিয়া সহ অসংখ্য নামি অনামি শৃঙ্গ। পারাং-লা অঞ্চলটাও শৃঙ্গ থেকে সুন্দর দৃশ্যমান।  সামিটের পিছনে প্রচুর ফুটিফাটা ক্রিভাস হ্যাঁ করে আছে। শিখর পূজা ও ছবি তুলে বেলা ১১-১৫ নাগাদ নীচে নামতে শুরু করলাম। এক্কেবারে যথার্থ অধঃপতন আর কি! বেলা ৩টে নাগাদ দেখতে পেলাম বেস ক্যাম্পে অপেক্ষারত মানুষগুলোকে যার মধ্যে দুটি আট-ন’ বছরের শিশুও ছিল।  কাছে আসার পর ওদের প্রথম প্রশ্ন, “সামনের বার আমরাও সামিটে যেতে পারবো তো?”  বললাম, “নিশ্চয়ই পারবি।” আসলে সকল প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে উত্তুঙ্গ হিমালয়ের মোহময় হাতছানিতে ঘর ছাড়তে পারাই তো আসল জয়।

পিছন ফিরে আবার কানামোর দিকে তাকালাম, ছোট্ট দুই অভিযাত্রী হাতজোড় করে নমস্কার করলো। কি করা যাবে ! গভীর কুয়াশার আলো আঁধারিতে শোনাইয়াকের গলার ঘন্টা যে মন্দিরের ঘন্টাধ্বনির থেকেও পবিত্র শোনায়।

শেয়ার করুন সবাইকে
error: Content is protected !!