
আরোহী মহলে রবীনবাবু, মানে রবীন ব্যানার্জি খুবই পরিচিত এক নাম। তাঁর খ্যাতি শুধু আরোহী হিসেবে নয়, একজন অতি-উদ্যমী সংগঠকের ভূমিকায় তাঁকে আমরা দেখেছি। শুধু হিমালয়ের অন্দরে বা প্রশিক্ষণ শিবিরে নয়, পর্বত সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে তাঁর সংযোগ ও সক্রিয় উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই রবীনবাবু একদিন শহরের চেনা চৌহদ্দি ছেড়ে উধাও হয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন, জানতে সময় লেগেছে। কেন গেলেন, জানা গেল না। তাঁর অনুগামী বন্ধুজন চেষ্টা করেছিলেন, ব্যর্থ হয়ে ক্ষান্ত দিয়েছেন। সেই দূর তড়াগতালে তাঁর পরবাসের চমকপ্রদ বৃত্তান্ত শুনিয়েছেন সুশান্ত ভট্টাচার্য
“কত যোজন পথ পেরোলে কত দিনের অনিশ্চয়
আমার উপর ভর করেছে? বিষেই যদি বিষক্ষয়
নীল হয়ে থাক কণ্ঠ আমার, ওষ্ঠে থাকুক সংবৃত
বিষের ছলে পান করেছি জীবনমুখী অমৃত “
… পৌলোমী সেনগুপ্তের ‘ অমৃত মন্থন ‘ থেকে।
শরীরের কলকব্জা নাড়িয়ে অবশেষে চামোলি থেকে আমাদের গাড়ি এসে থেমেছে বিরমাতা গ্রামে। পথের পাঁচশ’ ফুট নিচে বয়ে চলেছে বিরহি গঙ্গা। জনপ্রবাদ, দক্ষযজ্ঞে সতীর মৃত্যুর পর বিরহকাতর দেবাদিদেব এই নদীর পাড়েই বসে কঠিন তপস্যা করেছিলেন। বিরহাকুল মহাদেবের নামেই এই নদীর নাম বিরহি বা বিরেহি।
নদীর দক্ষিণ পাড়ে গোনা- বাগাড় গ্রাম।
‘বাগাড় ‘ মানে নদীর পাড়। নদীর ওপারে আরো উঁচুতে পাহাড়ের পাদদেশে জড়াজড়ি করা বেশ ক’টি ঘর নিয়ে ‘ ‘আপার গোনা গাঁও’।
গাড়ি যেখানে থেমেছে, সেটা পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে কিছুটা প্রশস্ত জায়গা। ওখানে চারদিক খোলা একটা সিমেন্টের গুদামে ডাঁই করে রাখা আলুর বস্তা। এগুলো নিচের এবং ওপরের গাঁয়ের ফসল। আঞ্চলিক পাইকারেরা ওগুলো শহুরে জনপদের বাজারে চালান করে।
এখান থেকেই আমাদের হন্টন শুরু। চামোলি বাজার থেকেই রবীনদা ফোনে ব্যবস্থাটা করে রেখেছিল। গুমান সিং, রামবাহাদুর এবং আরো তিনজন আঞ্চলিক চরিত্র একটা খচ্চর নিয়ে হাজির। খচ্চরের পিঠে আমাদের চারজনের রুকস্যাক চাপানোর অবকাশে তিনটে স্থানীয় বাচ্চা অবাক চোখে আমাদের দেখছিল। আলাপ জমানোর সুযোগটা হাতছাড়া করিনি। ওরা হিন্দি ভাষা খুব একটা বোঝে না। কিন্তু ম্যাজিকের ভাষা সর্বজনীন। জাদু দেখাবার সরঞ্জাম আনিনি। হাতের কাছে যা’ পেয়েছি তাই দিয়েই ‘ ইম্প্রমটু ‘ জাদু দেখানো শুরু করেছি। বাচ্চা তিনটি আমার ‘ ইন্সট্যান্ট ফ্যান’ হয়ে গেছে।
সবাই বিরমাতা থেকে বিরহি গঙ্গার উপনদীর ওপর সেতু পেরিয়ে এগিয়েছি পূবের সবুজ জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের মাথার উদ্দেশ্যে। আমি গুমান সিং আর তিন সোনা বন্ধু সবার আগেই চড়াই উঠতে শুরু করেছি, পরে জেনেছিলাম, এই গুমান সিং-ই তড়াগ তাল গাঁয়ে রবীনদার থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
দলে আমরা চারজন। অরুণ চক্রবর্তী, সজল ভট্টাচার্য, আমি এবং স্বয়ং রবীন ব্যানার্জী।
শেষ বিকেলের বিমর্ষ হয়ে আসা আকাশে মাথা তোলা তিন হাজার ফুটের অরণ্যময় চড়াইয়ের মাথাটাই আমাদর লক্ষ্য। ঐ ওপরেই কোথাও তড়াগতাল গ্রাম।
আমার সেই ছোট্ট তিন বন্ধু আরো জাদু দেখবার উদ্দেশ্যে বেশ কিছুটা চড়াই ভেঙেছে। গুমান সিং অনেক বকেঝকে ওদের তাড়িয়েছে বটে, কিন্তু আমাকে কথা দিতে হয়েছে যে ফেরার পথে বিরমাতা গাঁয়ে ওদের আরও জাদু দেখাতে হবে।
আমাদের দলের তিনজনই পায়ের ঝামেলায় কাবু। রবীনদার হাঁটুতে আ্যডভান্সড্ অস্টিওআর্থ্রোসিস, গুমান সিং এর অবস্থা তথৈবচ। নেহাৎ পাহাড়িআদমি বলেই এ পর্যন্ত আমার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। আমি দু হাঁটুতে গাউটের ব্যথায় একমাস শয্যাশায়ী থেকে সবেমাত্র এসেছি। পায়ের পেশিতে জোর নেই। সজল ভট্টাচার্যের পায়ের অবস্থাও ভালো নয়, তবে ওর ইতিহাস অন্যতর। দু’হাজার সাত সালে আউলিতে হ্যাঙ্গ গ্লাইডিং করবার সময় গ্লাইডারের একটা ডানা হঠাৎ ‘কোলাপ্সড্’ হয়ে ভদ্রলোক প্রায় পঞ্চাশ ফুট নিচে পড়ে গিয়েছিল। একেবারে ‘ফ্রি ফল’! পায়ে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার এবং সেরিব্রাল কনকাশন নিয়ে সজলদা বেশ ক’দিন কোমায় ছিল। এরপর দু’হাজার সতেরো সাল পর্যন্ত কয়েকবার অপারেশন, ফিজিওথেরাপি, রিহ্যাবিলিটেশন ইত্যাদি ঝক্কির পরও লোকটা দমেনি। হাতে এবং পায়ে নিউরোলজিক্যাল ঝামেলা নিয়েও দুটো ওয়াকিং পোল হাতে সজলদা দিব্যি হাঁটছে। একমাত্র অরুণই আমাদের মধ্যে সুস্থ।
আমি আর গুমান সিং সবাইকে ছাড়িয়ে অনেকটা ওপরে ছিলাম। গুমান সিং কমপ্লিমেন্ট দিলো, ‘আপ বহত তেজ চলতে হ্যাঁয়।’ বড় মনস্তাপ হয়েছে যে আমার পা দুটো ভালো থাকলে ওকে দেখিয়ে দিতাম যে আমি কতটা তেজ চলতে পারি। একসময় গুমান সিং কে অনেকটা নিচে ফেলে আরো ওপরে উঠে এসেছি।
বিরমাতা গ্রাম থেকে রামবাহাদুর সাবধান করেছিল যে ওই জঙ্গলে ভালুকের উৎপাত বেড়ে গেছে। ইদানীং কিছু ‘বেয়ার অ্যাটাক’ এর ইতিহাসও শুনে নিয়েছি। জঙ্গলে বুনো শুয়োর আর লেপার্ডও আছে। ওদের নিয়ে অতটা চিন্তা না থাকলেও ভালুক জানোয়ারটা বড় মাথা গরম, বড় আনপ্রেডিক্টেবল। যখন তখন বিনা নোটিশে আক্রমণ করে বসে। মৃত্যুর ঘটনা না,থাকলেও জঘন্যভাবে ‘মল’ করবার একাধিক ঘটনা এই অঞ্চলেই হয়েছে।
পঞ্চাশ ফুট ওপর থেকেই শুরু হয়েছে ঘনতর অরণ্য। বোল্ডার ছড়ানো আঁকাবাঁকা চড়াই পথের দু’পাশে বাজ, তেলিং, ভেঙ্গল, খরসু, রিঙ্গাল, রুইস আর হাজারো নাম না জানা গাছের ঠাস বুনোট সবুজের ভীড়। আমাদের মালপত্র নিয়ে খচ্চরওয়ালাটা ওর চতুষ্পদকে নিয়ে আমায় পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যা নেমেছে। হঠাৎ মনে হ’ল আমি একদম একা। বাকিরা কতটা নিচে, জানি না। আমি ওখানেই থেমে গেছি। চারপাশ দেখে টনক নড়েছে যে এখানে ভালুক আক্রমণ করলে করবার কিচ্ছু নেই। এটা একান্তই ওদের রাজপাট। আমার হাতে একটা লাঠি কিংবা টর্চ নেই। অস্ত্র হিসেবে চারপাশে অজস্র পাথর থাকলেও ; শুধু পাথর ছুঁড়ে ভালুকের ‘স্যাভেজ অ্যাটাক’ ঠেকানো দুঃসাধ্য। দল বেঁধে এগোনোই শ্রেয়।
আধঘন্টার সশঙ্ক অপেক্ষার পর অরুণদা, রবীনদা, সজলদা এবং গুমান সিং রা এসে পড়েছে। আরো আধঘন্টা চড়াই ভাঙবার পর রবীনদা পথের পাশে বোল্ডারে বসে পড়ে বলেছে, ‘স্যান্টো, এই পা নিয়ে তড়াগ তাল পৌঁছাতে আমার রাত এগারোটা বেজে যাবে। এখনো আদ্ধেক পথই আসিনি। তোরা গুমান সিং কে নিয়ে চলে যা। গিয়ে মাল খালি করে খচ্চর টাকে পাঠিয়ে দে। আমি দুটো ছেলেকে নিয়ে এখানেই অপেক্ষা করছি।’
এবার টর্চ জ্বালাতেই হল। জঙ্গলের রাত আরো কালো। আমার টর্চটা স্যাকের সঙ্গে খচ্চরের পিঠে চলে গেছে বলে অরুণ আর সজলদার মাঝখানটাই বেছে নিয়েছি। ওদের হাতে টর্চ রয়েছে। অরুণ বারবারই এগিয়ে আমার জন্যে টর্চের আলো ফেলছে। পেছনে সজলদার টর্চের আলোও অনেকটা সহায়। অসংখ্য এবড়ো খেবড়ো পাথরসংকুল পথে একবার পা মচকালে চিত্তির। দুটো আলোর দিশায় সতর্ক পা ফেলে একসময় উঠে এসেছি, ‘আঁসু পানি’-তে। পথের পাশে পাথর দিয়ে তৈরি দেয়ালে একটা পাহাড়ি নালাকে বন্দী করে একটা লোহার নলের ‘ আউটলেট ‘ করা হয়েছে। সেই নল দিয়ে ঝরে পড়ছে জল। এই জলের উৎসটা প্রাকৃতিক হলেও উপযুক্ত জায়গায়। এখানে এসেই গলা শুকিয়ে কাঠ। আঞ্চলিক বিশ্বাস, দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর বেদনাতুর শিব নাকি কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। এই নালাটা সেই নয়ননীর, তাই আঁসু পানি। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বসেছি। অরুণ আঁজলা ভরে জল খেয়ে মন্তব্য করল, ‘শিবের চোখের জল কিন্তু নোন্তা নয়।’ সজলদা বললো, ‘চোখের জল না হয়ে শিবাম্বুও তো হতে পারে।’
পরে জেনেছি, পাহাড়ি নালাকে কবজা করে কনডুইট তৈরী করবার কৃতিত্বটা রবীনদারই।
আমাদের অনেকটা নিচে জঙ্গলের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে মাঝে মধ্যে আগুয়ান হেড টর্চের আলো দেখে বুঝলাম, রবীনদারা এগোচ্ছে। আঁসু পানি থেকে চল্লিশ মিনিট চড়াই ওঠবার পর বিরক্ত হয়ে পড়েছি। পথের শেষ কোথায়! স্পষ্ট মনে না থাকলেও, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ – এ অবধূত এরকমই লিখেছিলেন যে, লক্ষ্যে পৌঁছোবার ব্যাকুলতা পথের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেয়। ভারী সত্যি কথা।
আরো চল্লিশ মিনিট চলবার পরই সমতল প্রশস্তি। অর্থাৎ রিজের মাথায় উঠে এসেছি। দু’পাশে পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে বানানো তিন ফুট উঁচু দেওয়ালের মাঝখানে পাথর বাঁধানো পথ এখন অনেকটা নিরাপদ।
রাত সম্ভবত আটটা। সামনে দুটো আলো দেখতে পেয়েছি। গুমান সিং ব্যাখ্যা করলো, ‘গাঁও কি লাইট হ্যায়।’
আরো কিছুটা এগোতেই কিছু ঘরবাড়ি নজরে পড়েছে। অনেকগুলোই অন্ধকার আর দৃশ্যত-ই পরিত্যক্ত। আসন্ন শীতের জন্য অনেক বাসিন্দাই নিচের গাঁয়ের নিরাপত্তায় নেমে গেছে।
এরই মধ্যে গুমান সিংয়ের চেঁচামেচিতে আমাদের খচ্চরওয়ালার সাড়া পাওয়া গেল। গুমান সিং খচ্চর সমেত ওকে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে রবীনদা কে নিয়ে আসবার জন্যে। দু’তিনশ গজ দূরে মিটমিট করে জ্বলা আলোটাই আমাদের গন্তব্য। ওটাই রবীনদার আস্তানার আলো।
আমি পথ চলতে চলতেই স্বগতোক্তি করেছি, ‘রবীনদাকে নিশ্চয়ই পাগলা কুকুরে কামড়েছিল, নইলে সুস্থ মস্তিষ্কে কেউ এমন পান্ডব বর্জিত তল্লাটে এতোটা বছর থাকতে পারে!’
‘পাগলা কুকুর নয়’, সজলদা চিন্তিত মুখে মতামত দিলো, ‘ব্ল্যাক মাম্বা কিংবা কোমোডো ড্রাগনের মতো আরো বিষাক্ত কোনো জানোয়ারের কাজ।’
অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছেছি। একচিলতে উঠোন নিয়ে কাঠ আর পাথরের তৈরী দোতলা বাড়ি। বাড়ির দোতলার তিনটে কামরার মাঝেরটাই আমাদের ঘর। নিচের তিনটে ঘর যথাক্রমে রসুই, গুদাম এবং খচ্চরের আস্তাবল। অন্ধকারে আর কিছু ঠাহর করবার উপায় বা ইচ্ছে ছিল না।
এতক্ষণ হাঁটছিলাম বলে মালুম হয়নি, জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। মিনিট পঁচিশ পর বাইরে ঘনৌল (খচ্চরের গলার ঘন্টা) -এর আওয়াজ শুনে বুঝলাম রবীনদার আবির্ভাব হয়েছে। হাতে হাতে এসে গেছে গরম জল, এরপর প্রাণদায়ী লিকার চা। তিনটে খাটে চারজন কম্বল মুড়ি দিয়ে বসেছি। আপাতত এখানে আমাদের দেখভালের দায়িত্বে তৎপর রামবাহাদুর, ওর বৌ মিনা আর বড় ছেলে শিব। রামবাহাদুরের আরও দুটো ছেলে আছে, হরি আর সঞ্জু। রেখা নামের একটি মেয়েও আছে। এরা নেপালী হলেও নেপালের সঙ্গে আর ওদের সম্বন্ধ নেই। ওর পরের প্রজন্ম গাড়োয়ালি ভাষাতেই কথা বলতে স্বচ্ছন্দ্য, চেহারাগুলোই নেপালি। নেপালি ভাষা জানেই না। ঘরে বসে পা গরম করতে করতে রামবাহাদুরের সঙ্গে বাতচিত করেই এসব তথ্য জেনেছি।
পাঁচমিশালি সবজি, রাজমার ডাল আর রুটির ডিনারের পর সবাই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছি।
বিরমাতা গ্রাম থেকে তিন হাজার ফুট ওপরে সাত হাজার চারশ’ ফুট উচ্চতার তড়াগতাল গ্রামে উঠে আসতে আমাদের ছ’ কিলোমিটার চড়াই ভাঙতে হয়েছে।
এখানে আসবার একটা উদ্দেশ্য আমার অবশ্যই ছিল। কৌতূহলটা বহু বছরের। একজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী, নিরুপদ্রব চাকরিজীবী হঠাৎ আত্মীয় স্বজন, চাকরি-বাকরি, বন্ধু বান্ধব আর আমারই মতো অসংখ্য ভক্তকে পেছনে ফেলে এখানে, এই তড়াগতাল গাঁয়ে এসে সুদীর্ঘ দশ-দশটা বছর একটানা কাটিয়ে দিয়েছে! কেন ? কিকরে ? কলকাতায় এর সদুত্তর পাইনি। রবীনদার বন্ধু বলে হয়তো সজলদা উত্তরটা জানে।
ছিয়াশি সালে রবীনদা কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ উধাও। তখন কানাঘুষোয় শুনেছি যে রবীনদা তড়াগতালে আছে। ছিয়ানব্বই সালে কলকাতায় ফিরে এলেও তড়াগতাল গ্রামের সঙ্গে রবীনদার সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। ও প্রায় নিয়মিত কলকাতা থেকে এ গাঁয়ে আসা যাওয়া করে।
রবীনদা যখন আমার বাড়ি এসে কথায় কথায় বলেছে যে অরুণ আর সজলদাকে নিয়ে ও তড়াগতাল যাচ্ছে, তৎক্ষনাৎ বায়না ধরেছি যে আমিও যাবো। উদ্দেশ্য দুটো। আমার পর্বতজীবনের একজন শিক্ষাগুরুর সাথে যাবার সৌভাগ্য, আর, কথায় কথায় জেনে নেয়া যে কেন রবীনদা হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে বিবাগী হয়ে এখানে চলে এলো। কারণটা স্পর্শকাতর হতে পারে। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ পর্বতারোহীকে এ বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা অভব্যতা হতে পারে। একই কারণে রবীনদার সমসাময়িক সতীর্থদের জেরা করাও অভদ্রতারই নামান্তর।
কম্বল ছেড়ে উঠবার ইচ্ছে ছিল না। আমি খালি গা ছাড়া ঘুমোই না। কম্বলের ফাঁক দিয়ে যেটুকু হাওয়া ঢুকছে, সেটা হাড় কাঁপানো। অরুণ অবশ্য আগেই উঠে ক্যামেরা নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়েছে।
পূবের সবুজ পাহাড় টপকে সকালের রোদ যখন গ্রামের তল্লাট ধুয়ে জানালা গলে ঘরে ঢুকছে, তখন গাত্রোত্থান করেছি। সবজি রোটির ভরপেট প্রাতরাশ করে বাইরে এসে রৌদ্রস্নাত তড়াগতালে অনুসন্ধিৎসু নজর বোলালাম। ঝলমলে রোদের মধ্যে মাঝেমধ্যে শিরশিরে বাতাসের খুনসুটি। ঝিরঝিরে মর্মরে উড়ে যাচ্ছে দুটো খরসু গাছের জীর্ণ বৃন্তে শিথিল হয়ে যাওয়া হলদে, বৃদ্ধ পাতারা। আমাদের বাড়ির নিচের আস্তাবল থেকে ঘনৌলের ডিং ডং বাজিয়ে বাইরের রোদে ঘাস খেতে বেড়িয়ে এসেছে দুটো খচ্চর আর এ বাড়ির কুকুর ঝংকু। আমাদের সঙ্গে ওর অনায়াস সখ্যতা হয়ে গেছে।
পাহাড়ে ঘেরা গ্রামটা অবতল বাটির মত। পূবের পাহাড়ের পাদদেশে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘরবাড়ি নিয়ে হরিজনদের বসত। অপেক্ষাকৃত সমতল, উর্বর জমিগুলো ক্ষত্রিয়দের অধিকারে। ঐ পূবের সবুজ পাহাড়ের গিরিশিরা ধরে উত্তরে তিনদিন ট্রেক করে সপ্তকুন্ড গিয়ে ত্রিশূল পর্বত দর্শন করে আসা যায়। উত্তর দিকে কিছুটা অবতল জমিতে প্রায় শুকিয়ে আসা ‘ওয়াটার হোল’-এর মত পনেরো -বাই- পনেরো ফুটের অগভীর লেকটার আঞ্চলিক নাম ‘সিকুতাল’। ক’বছর আগে নাকি লেপার্ডের তাড়া খেয়ে একটা বার্কিং ডিয়ার বর্ষার ভরা সিকুতালে এসে পড়েছিল। এ গাঁয়ের লোকেরা ঢিল ছুঁড়ে অসহায় প্রাণিটাকে মেরে মহাভোজে মেতেছিল। আজও, কল্পনাতে সে দৃশ্য দেখতে চাই না।
উত্তর -পশ্চিমের ‘স্কাই-লাইন’- এ এখান থেকেই দেখা যায় এলোটা পাস আর কুয়াঁরি পাস কে। ঝিঁ ঝিঁ গ্রাম থেকে নদি পেরিয়ে পাগানা গ্রাম ধরে ডোম-বিট-গাধেরা, ডাকোয়ানি হয়ে যে বিসর্পিল পথটা কুয়াঁরি পাস পর্যন্ত উঠে গেছে, সেই পথের শেষ অংশটা এখান থেকেই স্পষ্ট।
ডাকোয়ানি কথাটা গাড়োয়ানি ভাষায় ‘ডাকোয়া’ বা ডাক-হরকরা থেকেই এসেছে। চামোলি শহর থেকে চিঠিপত্র দূর-দূরান্তের পাহাড়ি গাঁয়ে পৌঁছে দেবার জন্য ডাকোয়াদের ‘রিলে সিস্টেম’ আছে। একজন ডাকোয়া হয়তো একদিক থেকে পাহাড়ের মাথায় চিঠির বোঝা নিয়ে উঠলো ; অন্য একজন ডাকোয়া বিপরীত দিক থেকে উঠে সেই চিঠিপত্র নিয়ে ওদিককার গাঁয়ে বিলি করার দায়িত্ব নিল। এই হাতবদলের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে। ঐ ডাকোয়ানি তাদের একটা। যে দুর্গম পথে এরা এই দুঃসাধ্য কর্তব্যটা করে সেটা আমাদের কাছে অকল্পনীয়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য সে খবর রাখলে ওর ‘রানার’ কবিতাটা যে আরো রোমহষর্ক হ’ত, সে ব্যাপারে আমি নিঃসংশয়।
ডোম-বিট-গাধেরা নামের নালাটার ইতিহাসও রবীনদার মুখেই শোনা। কোনো এক অতীতে একজন ক্ষত্রিয় তপোবনের দিক থেকে কুঁয়ারি পাস হয়ে নামছিল। উল্টোদিকের পাহাড় বেয়ে এক হরিজন একই গিরিবর্ত্মের দিকে উঠছিল। দু’জনেই পথশ্রমে ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত।
হিন্দিতে একটা প্রবচন আছে —-
ভুখ্ না মানে ঝুটেকি পাত
নিঁদ না মানে মুর্দে কি খাট
প্রেম না মানে জাতপাত।
শেষ পংক্তিটার একটু পরিবর্তন দরকার ছিল —
‘প্রেম ওর প্যায়াস না মানে জাতপাত ‘
ঐ দু’জন ভিন্ন জাতের লোক একই নালা থেকে বাধ্য হয়ে জল খেয়ে সেই গর্হিত কাজটা করেছিল। সেই থেকেই নালাটার নাম ডোম ( হরিজন) -বিট (ক্ষত্রিয়) – গাধেরা ( নালা)।
এটা রীতিমতো ঐতিহাসিক ঘটনা। চারপাশে কুমালা, পঠেলা, বিরমাতা, মান্দ্রা, নিজমুলা, গোনা পাগানা, ভানালি, ঝিঁঝিঁ, ইরানি ইত্যাদি সব গ্রামেই জাতপাতের ভীষণ কড়াকড়ি। ক্ষত্রিয় দের ঘরে হরিজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কালেভদ্রে ক্ষত্রিয়রা কৃপা করে হরিজনদের খেতে দিলে ঝড়-বাদল কিংবা তুষারপাতের মধ্যেই বেচারি হরিজনেরা বাইরে বসে নিজেদের আনা বর্তনেই খায়।
একবার রবীনদার ঘরে দুটো হরিজনের বাচ্চা ছেলে নিজেদের আনা রুটি গরম করেছিল বলে রীতিমতো পঞ্চায়েত সভা ডেকে রবীনদাকে প্রায় গ্রামছাড়া করবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ততদিনে অবশ্য চারপাশের গাঁয়ে চিকিৎসা করবার সুবাদে রবীন দা সবার কাছে ‘ডক্টরজি’ কিংবা ‘পন্ডিতজি’ বলেই পরিচিত। চিকিৎসার সুযোগ যেখানে বহুদূরের ব্যাপার, সেখানে রবীনদার দাপট – প্রশ্নাতীত। রোগী দেখবার জন্যে রবীনদাকে মাঝেমধ্যেই প্রত্যন্ত জনপদে ছুটতে হয়। নদী-নালা পেরিয়ে পাগানা, দুর্মি, ইরানি ইত্যাদি দূরান্তরের গ্রামে। আমি নিজে ডাক্তার হয়েও এখানে রবীনদার ইমেজ ভাঙতে পারিনি।
সে যা-ই হোক, পঞ্চায়েত সভায় রবীনদা প্রশ্ন তুলেছিল যে, বাচ্চাদের আবার জাত কি? সে প্রশ্নেরও সদুত্তর না পেয়ে রবীন দা ধনুর্ভাঙা পণ করেছিল যে, আইন মেনে চললেও, চিকিৎসার জন্যে ও কা’রো ঘরে ঢুকবে না। ক্ষত্রিয় হোক বা হরিজন ; রবীন দা বাইরে বসেই ‘ইলাজ ‘ করবে। রোগী অথর্ব কিংবা মরণাপন্ন হলেও বাইরে এনে রোগীকে দেখাতে হ’বে। স্বাভাবিকভাবেই ডক্টরজির এই শর্ত হজম করতে পঞ্চায়েত সভাসদদের বেশ অসুবিধে হয়েছে।
সভার উপসংহারটা গ্রামের উপপ্রধান ঘোষণা করেছিলেন, ‘পন্ডিতকে লিয়ে সব ছুট্ হ্যায়।’ ঐ সালিশি সভার অনুশাসন থেকে নিষ্কৃতি পেলেও রবীনদার শুভানুধ্যায়ী সেই উপপ্রধান আড়ালে রবীন দাকে সাবধান করেছিলেন, ‘…. গাঁও কি কানুন মানকে চলনা পন্ডিত! আপকো সামহালনেকে লিয়ে হরবার হম্ সাথ নেহি হোঙ্গে।’
রবীনদার মুখে এটুকু বৃত্তান্ত শুনে সজলদা আত্মগতের মত বলেছে, ‘বাট হোয়াই?’
‘কিসের হোয়াই?’ রবীন দা জিজ্ঞাসু। ‘প্রত্যেক ঘটনার কজ এবং এফেক্ট থাকে। এটাই নিয়ম’, সজলদা উত্তর দিল, ‘একটা আধুনিক, সভ্য, শিক্ষিত এবং খ্যাতিমান শহুরে লোক এতটা বছর এতসব ঝড়-ঝাপটা সামলে উত্তরাখন্ডের এক প্রত্যন্ত গ্রামের প্রেমে মজেছে, এগুলো তো এফেক্টস্। নেপথ্যে কজ টা কি?’
সন্দেহ নেই যে সজলদা অন্তত আমার মতই একই বিষয়ে কৌতূহলী ।
রবীনদা সজলদার ঔৎসুক্যকে উপেক্ষা করে প্রসঙ্গ টা ঘুরিয়ে পূবদিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলল, ‘ঐ ঘরটা দেখেছিস?’
সামান্য দূরেই পরিত্যক্ত একটা ভগ্নপ্রায় ছোট দোতলা বাড়ি আছে। রবীন দা বলল, ‘ঐ বাড়িটার একটা ঘরে আমার দশ বছর কেটেছে। আগে বরং তোদের উল্টাপানি টা দেখিয়ে আনি।’
আমরা শুকিয়ে যাওয়া সিকু লেকের বেড ধরে উত্তরে কিছুটা এগিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে থাকা খরসু, বাঁজ বা তেলং গোত্রের ওক গাছের পাশ দিয়ে আবার পশ্চিম দিকে নামতে শুরু করেছি। প্রায় পঞ্চাশ ফুট নিচে একটা পাহাড়ি নালা আছে। এটাই তড়াগতাল গাঁয়ের খাবার জলের উৎস। পাহাড়ি গ্রামে খাবার জলের উৎস সাধারণত গ্রামের জমি থেকে উঁচুতেই থাকে। তাতে জল বয়ে আনা সহজ হয়। এখানে জলের ‘সোর্স্’ টা নিচে বলেই নালাটার চলতি নাম ‘উল্টা পানি’।ঐ নালাটার জল বহু নিচে বয়ে মিশেছে বিরহি-গঙ্গার প্রবাহে।
রাম বাহাদুরের কাছ থেকে একটা দুঃসংবাদ শুনলাম। আজই সকাল আটটা নাগাদ গাঁয়ের এক মহিলাকে ভালুক আক্রমণ করেছে। গাঁয়ের মেয়েরা সকালে পিঠে ঝুড়ি আর হাতে দারান্তি (হেঁসো) নিয়ে দল বেঁধে ঘাস কাটতে যায়। ঐ আক্রান্ত মহিলা টি দলছুট হয়ে একটু তফাতে ঘাস কাটছিল। ভালুক টা ওর মুখের মাংস খুবলে নিয়েছে। একটা চোখ উপড়ে এসেছে। আমরা যে পথ ধরে তড়াগ তালে উঠে এসেছি, অকুস্হলটা সেই পথের পাশেই। শুনলাম ক্ষতবিক্ষত মেয়েটিকে চিকিৎসার জন্যে গোপেশ্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রবীনদার থমথমে মুখ দেখে আমি সান্ত্বনা দিলাম, ‘ চিন্তা করো না। ফেসিয়াল ইনজ্যুরি দেখতে ভয়ংকর হলেও প্রাণ যাবার সম্ভাবনা কম।’
রবীনদা আনমনার মত বলল, ‘চল্ তোদের তড়াগতাল টা দেখিয়ে আনি।’
রবীনদার সেই পুরোনো, পরিত্যক্ত বাড়িটার পাশ ধরে কিছুটা দক্ষিণে এগোলেই প্রমাণ প্রশস্তির তড়াগতাল। পথেই গুমান সিং এর বাড়ি। গোনা গ্রামে নেমে যাবার আগে গুমান সিং শীতের মরসুমের জন্যে নিজের বাড়িটা গোছগাছ করে রাখছিল। ওখানে বসে আমাদের দ্বিতীয় দফার চা খাওয়া হয়ে গেল।
এই ডিসেম্বরে তালের জল অনেকটা শুকিয়ে গেলেও চারদিকের ঢালু পাড়ের অবতলে শুকিয়ে থাকা পাঁপড় ভাজার মত শ্যাওলা দেখে লেকটার আদত মাপ আন্দাজ করা যায়। রবীনদা এই সরোবরে মাছ চাষেরও পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু এই এলাকায় সার্ভে করতে আসা কিছু জিওলজিস্ট পরীক্ষা -নিরীক্ষা করে মতামত দিয়েছে যে তালটা মাছ চাষের অনুপযুক্ত।
রবীন দা বলল, ‘এই তালে প্রচুর ভদক অর্থাৎ পরিযায়ী পাখী আসতো। ডিম পাড়া, ছানাদের উড়তে শেখানো পর্যন্ত এরা,থাকতো’
‘—থাকতো মানে?’
‘আর বলিস না’, রবীন দা আক্ষেপ করল, ‘এই শালা মানুষ জাতটা সর্বগ্রাসী। গাঁয়ের লোকেরা খাবার জন্য যথেচ্ছ ডিম চুরি করতো। ঐ তস্করবৃত্তির জন্যেই পাখীগুলো আর আসে না।’
পাখিগুলো কোন প্রজাতির কিংবা কোথা থেকে মাইগ্রেট করে সেটা অবশ্য রবীন দা বলতে পারে নি। বর্ণনা শুনে আমার মনে হয়েছে ওগুলো ‘রেড হেডেড ডাইভিং’ বার্ড।
লেকের পূব পাড়ে পাহাড়ের পাদদেশেই হরিজনদের বসতি। ঐ পাহাড় থেকেই তড়াগতালে জল খেতে নেমে আসে লেপার্ড, হরিণ, বুনোশূকরেরা। আমাদের কথাবার্তার ফাঁকেই দেখে নিয়েছি, একটা হিমালয়ান ম্যাকাক বোল্ডারে উবু হয়ে জল খাচ্ছে। ওদিকেই একবার একটা লেপার্ড একটা গরুকে আক্রমন করেছিল। গরু চরাতে যাওয়া মহিলাটি থামালি (রুঁইস কাঠের হাতলওয়ালা গাছ কাটবার ধারালো দা) দিয়ে লেপার্ড টাকে এলোপাথাড়ি আঘাত করেছিল। এ হেন অপ্রত্যাশিত প্রতি আক্রমণে হতভম্ব লেপার্ডটা রণে ভঙ্গ দিয়ে, শিকার ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল।
এমন সাহসী কন্যাশ্রীটিকে দেখার বড় ইচ্ছে হয়েছিল।
এরই মধ্যে মুখে মুখে খবর এসে গেছে যে ভালুকে আক্রান্ত মহিলাটিকে গোপেশ্বর থেকে শ্রীনগরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে কিছু করা যায়নি বলে ওকে চণ্ডিগড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ফিরে এসেছি রবীনদার কিচেনে। তখন গরমাগরম লাঞ্চ্ তৈরী হচ্ছে। চিরতার কাঠি দিয়ে তৈরি বুন (ঝাঁটা) দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করে পাতা হয়েছে বিবর্ণ কিন্তু পরিষ্কার সতরঞ্চির আসন। রামবাহাদুরের ছেলে সঞ্জু ভাদিলা (কড়াই) তে পাল্টা ( খুন্তি) নেড়ে মিঠা করেলার সবজি তে ফিনিশিং টাচ্ দিতে ব্যস্ত। রামবাহাদুর পরাত (আটা মাখাবার থালা) – এ আটা মেখে দু’হাতের দক্ষ তালিতে নিখুঁত গোল রুটি বানিয়ে চাটুতে ফেলছে।
এই প্রথম মিঠা করেলা খেলাম। এগুলো এখানকার করলা। কিন্তু তেতো নয়। মিষ্টি।
লাঞ্চ করে অরুণ বেরিয়ে পড়েছে ছবি তুলতে। বিশেষত পাখীর ছবি। এখানে অজস্র পাখী। এ বিষয়ে আমি গণ্ডমূর্খ। হলদে ম্যাগপাই, ফ্লাই ক্যাচার আর হিল ময়না ছাড়া বাকিগুলোকে চিনতে পারি নি।
আমি আর সজলদা তড়াগতালের আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। এই আয়েসি পদচারণার সময় সামান্য যে ক’জন গ্রামবাসীর সাথে দেখা হয়েছে, প্রত্যেকে বিনম্র একগাল হাসি নিয়ে ঝুঁকে নমস্কার জানাচ্ছে।এরা জানে আমরা রবীনদার অতিথি। সজলদা চিন্তিত মুখে বলল, ‘রবীন যে এখানকার একটি উল্লেখযোগ্য রত্ন সে তো বুঝলাম। কিন্তু হোয়াই? তুমি আসল ব্যাপারটাই ভাবছো না ডাক্তার। রবীনের কলকাতা থেকে অন্তর্ধানের পিছনে রহস্য টা কি?’
‘–রহস্য টা হয়ত কলকাতায়’, আমি বললাম।
‘হতে পারে’, সজলদা চিন্তিত মুখে বলল, ‘জানো তো ডাক্তার, মুজতবা আলীর একটা গল্পে পড়েছিলাম, ফ্রান্সের একজন নামজাদা জাস্টিস কোনো জটিল, রহস্যময় কেস হাতে পেলেই বলতেন, শের শে লা ফেম’, ফ্রেঞ্চ কথাটার অর্থ হল, লুক ফর দ্য উওম্যান। অর্থাৎ রহস্যের পিছনে মেয়েটাকে খোঁজো। সে হিসেবে কারণ টা কলকাতায় থাকা খুব বিচিত্র নয়।’
কলকাতা ছেড়ে রবীনদার এখানে আসবার নেপথ্যে কোনো ব্যর্থ প্রেমের প্রভাব আছে বলে অবশ্য আমার মনে হয় নি। যদ্দুর জানি ছোড়দার মুখে গোনাতালের গল্প শুনে রবীনদা গোনাতাল দেখতেই এসেছিল। তদ্দিনে অবশ্য গোনাতাল নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট ফ্লাডে। সে সময়ই ঘুরতে ঘুরতে ঘটনাচক্রে রবীনদার তড়াগ তালে আসা এবং এ গ্রামের প্রতি ভালোবাসা।
সজলদা আবারও হতাশ গলায় শূন্যকেই প্রশ্ন করছে, ‘দেন হোয়াই?’
পশ্চিমের সবুজ পাহাড়দের শ্যামল সীমানা ছাড়ানো গ্রানাইট পাহাড়রা যখন অস্তরাগে তামাটে লাল হয়ে গেছে তখন ফিরে এসেছি আমাদের দোতলার ঘরে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। চারজনই কম্বল মুড়ি দিয়ে আড্ডা মারতে বসেছি। বাড়ির কুকুর ঝংকুও একটু উত্তাপের লোভে ঘরের ভেতর দরজার পাশেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েছে।
রবীনদা ভালো করে গায়ে কম্বলটা জড়াতে জড়াতে বলছে, ‘আর দু’দিন পরই তড়াগতাল গ্রাম ফাঁকা হয়ে যাবে।’
‘সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি’, সজলদা মাথায় উলের টুপি টা পরতে পরতে মন্তব্য করেছে।
‘দাঁড়া, তোদের গা গরম করবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে’, রবীনদা বলেছে।
মিনিট দশেক পরই রামবাহাদুরের ছেলে এসে টেবিলের ওপর একজাগ গরমজল, চারটে গেলাস আর এক বোতল রাম রেখে বেরিয়ে গেছে। আমরা তিনজনই জানতাম না যে কোন ফাঁকে রবীনদা সঞ্জুকে মদ আনতে পাঠিয়েছিল। সজলদা স্লোগান দেবার ভঙ্গিতে বলে উঠেছে, ‘ ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।’
আমি আর অরুণ সমস্বরে সমর্থন করেছি ‘ইয়াক ইয়াক।’
রবীনদা বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে বলেছে, ‘ ভেবে দ্যাখ্ আমার একটা কথায় ঐটুকু ছেলে সাত কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে মাল আনতে গেছে।’
সজলদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, ‘অনেক ভেবেছি! বাট হোয়াই?’
রবীনদা গেলসে রাম ঢালতে ঢালতে সহাস্যে বলেছে, ‘ডিয়ার সজল, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে মরে গেলেও এ জীবনে হোয়াই এর উত্তরটা পাবিনা। বরং স্যান্টোকে দিয়ে একটা রহস্য কাহিনী লিখিয়ে নে। টাইটেলটা হবে— ‘বাট হোয়াই!’ ‘সব রহস্যেরই কি সমাধান হয়রে পাগলা!’
তড়াগতালের সন্ধ্যা কারণ-বশতই সেদিন সরগরম। মারকাটারি আড্ডা হল। অবশ্যই রবীনদা মধ্যমণি, ‘ কখনো বাংরিপোসি গেছিস?’
আমি বললাম, ‘না, তবে নাম শুনেছি।’
‘- ঐ বাংরিপোসি যাবার পথে সুবর্ণরেখা নদী ক্রস করলেই বাঁদিকে হাতিপোঁতা বাংলো। একসময় ওখানে একদিন ছিলাম। তা, নিছক কৌতূহলে সেদিন বাংলোর ভিজিটর্স্ বুকটা উল্টেপাল্টে নানান লোকের মন্তব্যগুলোতে চোখ বোলাচ্ছিলাম। একটা লেখাতে চোখ আটকে গেল। লেখা রয়েছে, ‘মহুয়া পেলাম না, তাই চলে যাচ্ছি।’ নিচে লেখকের স্বাক্ষর। কে জানিস?’
‘- কে?’
বরীনদা গ্লাসে হালকা চুমুক দিয়ে বলল, ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’
‘- আহারে! বাংরিপোসিতে কবিবর তেষ্টা মেটাতে পারেন নি’, অরুন সখেদে বলেছে।
রবীনদা ব্যাখ্যা করল, ‘আসলে ঐ তারিখের আগে তিনদিন ধরে সাঁওতালদের কোনো বড়সড় পরব ছিল। সেই পরবেই গাঁয়ের মহুয়ার স্টক ফিনিশ।’
গল্পে কবিতায়, গানে ঘনতর হয়েছে তড়াগতালের রাত। আমি উপদেশ দিলাম, ‘তোমার লেখার হাত এত ভালো। নিজের অভিজ্ঞতাগুলো লিখছো না কেন রবীনদা?’
রবীনদা কথাটার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘কাল তোদের জাঙ্গল ফাউল খাওয়াবো।’
‘– এখানে বন্য কুক্কুট পাওয়া যায়?’
‘- প্রচুর আছে। জানিস তো, এই বুনো মোরগদের একটা স্বভাব আছে। ওরা গাছের ডালেই রুস্ট্ করে। সকালে গাছ থেকে নেমে যে পথে খাবার খুঁজতে বেরোয়, সন্ধ্যেবেলা সে পথেই ফিরে এসে সেই গাছেই চড়ে বসে। সকালে ঐ পথে পায়ের ছাপ দেখে শক্ত সুতোর ‘মালা’ বা ফাঁদ পাতা হয়। সন্ধ্যেবেলা ফাঁদে পড়া পাখিগুলোকে কালেক্ট করা হয়। মাঝেমধ্যে একসঙ্গে চার-পাঁচটাও ফাঁদে পড়ে।
রবীনদা গ্লাসে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বলল, এই জাঙ্গল-ফাউল নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। ‘জানিস -ই তো, মাঝেমধ্যে আমার এখানে অনেকেই দিন কাটিয়ে যায়। ছোড়দা, নায়কদা-রা ছাড়াও সপ্তকুন্ড কিংবা কুয়াঁরি পাসের পথে যাওয়া দিশি-বিদেশি ট্রেকাররাও এই ঘরে থেকে গেছে। তা, আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক তড়াগতাল থেকে চারটে বন মুরগীর ডিম অতি সাবধানে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি নিজে মুরগী পুষতেন। তার ইচ্ছে ছিল নিজের পোষা মুরগী দিয়ে ঐ ডিমগুলো ফোটাবেন। চারটে ডিমের দুটো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাকি দুটো ডিম ফুটে ছানা হয়েছিল বটে, কিন্তু ছানাগুলো একটু উড়তে শেখার পরই শুরু হল বিপত্তি। সন্ধ্যেবেলা ছানাগুলোকে খাঁচায় ঢোকাতে গেলে ঐ দুটো ছানা উড়ে যে কোনো উঁচু জায়গায় উঠে বসে থাকতো। ঐ, কথায় আছে না স্বভাব যায়না মলে।’
‘– তোমার মতই আরকি’, সজলদা ফুট কাটলো, ‘নইলে কি আর এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসতে!’
নিচে কিচেন থেকে রামবাহাদুর হাঁক দিলো, ‘খানা তৈয়ার হ্যায় ডক্টরজি।’
ডিনারের পর মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছি। অন্ধকারেই রবীনদা বলল, ‘কাল তোরা স্কুলটা দেখে আয় আর ওদিককার গ্রামের মন্দিরটাও দেখে আয়। ঐ স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে পূবের স্কাইলাইনে চোখ রাখলে ত্রিশূল পিকটাও দেখতে পাবি।’।
পরদিন সকালেই আমি, সজলদা আর অরুণ তড়াগতালের দক্ষিন প্রান্তের দিকে এগিয়েছি। ওদিকে পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিচ্ছিন্ন ঘরবাড়ি, ফসলের ছোট ছোট ক্ষেত। প্রত্যেক বাড়ি থেকে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা। চায়ের আপ্যায়নের পর দুপুরে খেয়ে যাবার সনির্বন্ধ অনুরোধ। সবই রবীনদার কল্যানে। সজলদা ওদিকে বিড়বিড় করে তিব্বতি মন্ত্রোচ্চারণের মত জপ করে চলেছে, ‘বাট হোয়াই, জাস্ট হোয়াই?’ প্রাইমারী স্কুল আর মন্দির দর্শন করেছি বটে। তবে পূবের আকাশ কিছুটা বিষন্ন থাকায় ত্রিশূল-দর্শন টা আর কপালে জোটেনি।
ফিরে এসে দেখি কিচেনে জ্বলন্ত উনুনের চারপাশ ঘিরে জমজমাট আড্ডা হচ্ছে। রবীনদাকে ঘিরে একপাল আঞ্চলিক মহিলা হাসিঠাট্টায় মশগুল। রবীনদাও গাড়োয়ালি ভাষায় খই ফুটিয়ে চলেছে। আমি সজলদা কে নিচু গলায় বললাম, ‘হোয়াই এর জবাবটা তো দেখতেই পাচ্ছো। এমন ষোলোহাজার গোপিনী থাকলে রবীনদা কোন্ দুঃখে কলকাতায় ফিরবে!’
রবীনদা হাসি-মশকরা করার মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘স্যরি স্যান্টো, আজ তোদের মুরগী খাওয়াতে পারলাম না। রাম বাহাদুর সকালে মালা পেতে এসেছিল। কিন্তু ওদিকে একটা বেয়াড়া ভালুকের উৎপাত শুরু হয়েছে। ও আর ভয়ে ওদিক মাড়াতে চাইছে না। আজ বরং তোদের শিশনুর ঝোল খাওয়াবো।’
শিশনু অর্থাৎ পাহাড়ি বিছুটি। আমি ইতিপূর্বেও খেয়েছি। দুর্দান্ত স্বাদ।
ভরপেট লাঞ্চের পর আমি আর অরুণ কুয়াঁরি পাসের দিকে চোখ রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরের বছর ট্রেকিং -এর পরিকল্পনাটা ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। রবীনদা এসে একটা ছোট্ট চাবি অরুণের হাতে দিয়ে বলল, ‘প্ল্যান-প্রোগ্রাম পরে করিস। চল্, আগে আমার পুরানো ঘরটা দেখিয়ে আনি, যেখানে আমি দশটা বছর কাটিয়েছি।’
আমরা এগিয়েছি সেই ‘হেরিটেজ হোম’ এর দিকে। পূবদিকের পরিত্যক্ত সেই বাড়িটার নিচের তলায় যে ঘরটার তালা বেশ কসরৎ করে খুলতে হয়েছে, তার দরজাটা এত ছোট যে, মাথা অনেকটা ঝুঁকিয়ে, দু’পাশে গা বাঁচিয়ে ঢুকতে হয়। ঘরের মেঝে বড়জোর ছ’ফুট বাই পাঁচ ফুট। ভেতরে কোনো জানালা নেই। ভিতরে দুটি কুলুঙ্গি আছে । গাড়োয়ালিরা বলে ‘জালা’। সিলিং এর উচ্চতা মেরেকেটে সাড়ে পাঁচ ফুট। কুলুঙ্গির একটাতে একটা শুকিয়ে যাওয়া মৌচাক।
‘– এটা সেলুলার জেলের কয়েদিদের সেল’ অরুণ মতামত জানিয়েছে।
‘– না। এটা নিয়েনডারথ্যালের গুহা’, আমি বললাম।
সজলদা যোগ করল, ‘অসম্ভব! এটা রবীন বাঁড়ুজ্যে হতেই পারে না। ইনি রবীনসন ক্রুসো, বাট দ্য কোয়শ্চন স্টিল রিমাইনস্, হোয়াই?’
অরুণ ঘরের চারপাশ দেখে চিন্তিত গলায় স্বগতোক্তি করেছে, ‘এরকম একটা এসকেপ ভেলোসিটির পেছনে একটা পাওয়ারফুল ফোর্স্ থাকতে বাধ্য।’
সত্যি কথা। কেন একটা লোক কলকাতার শহুরে নিরাপত্তা আর আয়েস ছেড়েছুড়ে দশ দশটা বছর এই সংক্ষিপ্ত ঘরে পড়ে ছিল! কখনো প্রবল বর্ষায়, শীতে জনশূন্য হয়ে যাওয়া বরফ ঢাকা নিষ্করুণ পরিবেশে, একা! বাঘ ভালুকের উপদ্রব নয় ছেড়েই দিলাম। সে-তো জীবনে অনেক পাহাড়ি গ্রাম দেখে আমরা প্রায়ই বলে বসি — আহা, এখানেই সারাজীবন কাটিয়ে দিই। সেটা অন্তরের কথা হলেও, করে দেখাবার দম ক’জনের আছে!
এই এতটা বছর রবীনদা যে নিষ্কর্মা হয়ে বসে ছিলো তা’ নয়! মাত্র দু’দিনেই বুঝে গেছি রবীনদা এ গাঁয়ে একাধারে ডাক্তার, পন্ডিত, শিক্ষক, পঞ্চায়েত সভার সম্মাননীয় সদস্য, গ্রামে রাস্তাঘাট, জল-সরবরাহ, চাষবাস ইত্যাদির উপদেষ্টা, ঘটক (চারপাশের গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ের চার হাত এক করে দেবার কৃতিত্ব রবীনদার। এই রামবাহাদুর আর মীনার ঘটকালিও রবীনদারই কীর্তি) এবং ওঝা। দক্ষিণের গ্রাম থেকে রামবাহাদুরের বউ মীনা এসে হাত লাগিয়েছে আমাদের রাতের খাবার তৈরী করতে। বিকেল থেকেই আবহাওয়া আজ কিছুটা সন্দেহজনক। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে গেছে। অস্পষ্ট হয়ে এসেছে কুঁয়ারি আর এলোটা পাস। আমরা যথারীতি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘরের ভেতর। এবং আড্ডা।
রবীনদার ওঝাগিরির শোনার খুব ইচ্ছে হ’ল।
‘– বছরে পাঁচ -ছ’টা ভুতে ধরার কেস থাকবেই। একে তো আমি ব্রাক্ষ্মণ, তায় পন্ডিত। সুতরাং আমাকেও লোকাল ওঝার সঙ্গে একজরসিস্টের ভূমিকায় নামতে হয়। যে জায়গাটায় ভুতে ধরে, সে জায়গাটা আইডেন্টিফাই করাটা আঞ্চলিক ওঝার কাজ। সাধারণত জঙ্গলে ঘাস, কাঠ আনতে গিয়ে কিংবা গরু-ছাগল চরাতে গিয়েই ভুতের খপ্পরে পড়তে হয়। আটানব্বই শতাংশ ভিকটিম হচ্ছে মেয়েরা। ঐ অকুস্থলেই ভূত তাড়ানোর ক্রিয়াকর্ম হয়।’
‘– এই ইন্ফর্মেশনটা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জানা দরকার।’ সজলদা বলেছে, ‘যতদূর জানি, ভদ্রলোক পাহাড়ি ভূত নিয়ে চর্চা করেন নি।’
‘– তোমার ভূমিকা টা কি?’ আমি রবীনদা কে প্রশ্ন করেছি।
‘–গায়ত্রী হোক, গীতার শ্লোক, আদ্যাস্তোত্র, নবগ্রহ স্তোত্রই হোক, যেটুকু মনে আছে অং-বং-চং করে আউড়ে যাই। ওঝাগিরির পর অন-দ্য-স্পট খানাপিনার আয়োজন হয়। একটা কমন আইটেম হচ্ছে হাঁড়িতে সেদ্ধ করা বিস্বাদ মাংস। ওটা,আমার মুখে রোচে না। প্রসাদ বলে একটু মুখে ছুঁইয়ে বাকি ভুজ্যিটা বাড়িতে এনে তেল, ঝোল, মশলা দিয়ে তরিবত করে খাই।’
অরুণ জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তাতে কি ভূত ভাগে?’ রবীনদা উত্তর দিল, ‘আরে, হিস্টিরিয়া আর কতক্ষণ থাকবে! আসলে পেশেন্টকে কনভিন্স করানোর অ্যাক্টিংটা মোদ্দা কথা। স্যান্টো, তুই নিশ্চয়ই মানবি, এটাও এক ধরনের কাউন্সেলিং।’
রাজমার ডাল, শিশনুর ঝোল, ভাত আর রুটির নৈশভোজের পর অনেকক্ষণ রবীনদার কাছে তড়াগতাল সম্বন্ধে অনেক জেনেছি। সবকিছু বলবার মত পরিসর এখানে পর্যাপ্ত নয়।
তড়াগতালে আজ রাতে ঠান্ডাটা একটু বেশিই মনে হল।
সকালে বাইরে বেরিয়েই অরুণ ঘোষণা করেছে, ‘রাতে স্নো-ফল হয়েছে।’
বাইরে বেরিয়ে দেখলাম সত্যিই তাই। চারপাশের পাহাড়ের শিরায় শিরায়, পাথুরে মিনারদের গায়ে, তড়াগতালের ঘাসে সাদা ছোপ পড়েছে। নর্স্ উপকথার ফ্রস্টের দেবী, ‘ফ্রস্টি’ তড়াগতাল গাঁয়ে হাজির হয়েছেন।
আজ তড়াগতাল গ্রামকে বিদায় দেবার পালা। প্রাতরাশ করবার অবকাশে রামবাহাদুর আমাদের মালপত্র খচ্চরের পিঠে বেঁধে ফেলেছে।
রওনা হ’বার কুড়ি মিনিট পর জঙ্গলে ঘেরা একটা বাড়ি দেখিয়ে রবীনদা বলল, ‘ওটা সিতাপ সিং -এর বাড়ি। জানিস ঐ বাড়িতেই একটা ভালুক কি কান্ডটাই না করেছিল! আমার স্বচক্ষে দেখা। গোনা গ্রামে পৌঁছে তোদের গল্পটা বলবো।’
এবার উৎরাই ধরে নামবার পালা। এ রাস্তার প্রতি ইঞ্চি রবীনদার নখদর্পনে। হাঁটুর ঝামেলায় রবীনদা পিছিয়ে পড়ছিল। পেছন থেকেই ডেকে বলল, ‘চারটে বাঁকের পরই আঁসু পানি। ওখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করিস।’
আমাদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নেমে আসছে তড়াগতালের বাকি বাসিন্দেরা। কাঁধে বোঝা নিয়ে নারী-পুরুষের দল, গরু-ছাগল-খচ্চরের পাল নেমে যাচ্ছে নিচের গাঁয়ে। অসংখ্য ঘনৌলের মিষ্টি ঝংকারে কিছুক্ষণ স্পন্দিত হয়েছে অরণ্যের রহস্যঘন স্তব্ধতা।
আঁসু পানিতে পৌঁছোবার পনেরো মিনিট পর রবীনদা এসে পড়েছে। আমাদের পেরিয়ে যাওয়া গাঁয়ের অধিবাসীরা সবাই রবীনদা কে চেনে। এরই মধ্যে পিঠে কাঠের বোঝা নিয়ে রবীনদার উদ্দেশ্যে বিগলিত হাসি হেসে বছর তিরিশের এক মহিলা নেমে আসছিল। রবীনদা আমায় কনুইয়ের খোঁচা মেরে বলল, ‘নে স্যান্টো, এই তোর কন্যাশ্রী। এই মেয়েটাই থামালি দিয়ে লেপার্ড তাড়িয়েছিল।’ আমি কিছু না বলে অন্তর থেকে সসম্ভ্রম নমস্কার জানিয়েছি ঐ মহিলাকে।
আঁসু পানি থেকে আবার উঠতেই রবীনদা জানালো, ‘আরো চারটে বাঁক পেরোলে রাস্তার পাশে একটা বসবার জায়গা আছে। ওখানে ওয়েট করিস।’
ঠিক চারটে বাঁকের শেষেই পথের পাশে বোল্ডার সাজিয়ে তৈরী বসবার জায়গাটা পেয়ে গেছি। ওটা দৃশ্যতই প্রাকৃতিক নয়। দিব্যি মালুম হল ওটা মানুষের হাতেই তৈরী।
কুড়ি মিনিট পর রবীন দা এসে ব্যাখ্যা করল, ‘জানিস, একবার একদল গাঁয়ের মেয়ে আমাকে ধরে অনুরোধ করেছিল যে ওদের জন্য এখানে একটা বিশোনা তৈরী করে দিতে হ’বে। বিশোনা হচ্ছে বসবার উঁচু জায়গা। আসলে নিচের গ্রাম থেকে ভারী বোঝা বয়ে মাটিতে বসলে উঠতে কষ্ট হয়। এই জায়গাটা ওদের রেস্টিং পয়েন্ট। দেখেছিস তো এর পরের চড়াইটা আরো খাড়া। একটু উঁচু জায়গা হলে ওদের বোঝাসুদ্ধ বসতে আর উঠতে সুবিধে হয়। তা, আমি মেয়েগুলোকে বললাম যে, প্রত্যেকে পাশের স্লোপ থেকে একটা করে বড় বোল্ডার বয়ে নিয়ে এলে একটা করে বিড়ি দেব। জানিস, বিড়ি হচ্ছে ওদের প্রাণ। এক বান্ডিল বিড়ি দিলে যে কোনো মেয়ে তোর সঙ্গে শুতে রাজি হয়ে যাবে।’
সজলদা মোক্ষম প্রশ্ন করেছে, ‘সেটা তুমি কি করে জানলে বাঁড়ুজ্যে?’
‘– সেটা তোর গবেষণার বিষয়।,’ রবীনদা সজলদার দিকে একবার তির্যক চোখে তাকিয়ে আবার বলল, ‘যাই হোক, মাথা পিছু একটা করে বিড়ি ঘুষ দিয়ে হাতে হাতে পাথর সাজিয়ে তৈরী এই বিশোনা।’
সজলদা মন্তব্য করেছে, ‘ভাগ্যিস, বিশোনার বদলে এখানে বিছানা পাতবার জায়গা নেই।’
আবারও উঠেছি। রবীনদা আবারও নির্দেশ দিয়েছে, ‘আরও তিনটি বাঁকের পর আরও একটা বসবার জায়গা আছে। অপেক্ষা করিস। একটা ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য আছে।’
তিনটে বাঁক পেরিয়ে আবার বড়সড় পাথরের ‘আউটক্রপ’। পাশেই ঘন জঙ্গলের মধ্যেও কিছুটা দূর পর্যন্ত একটু ফাঁকা জায়গা। অজস্র বিরুৎ আর গুল্ম গজিয়ে উঠলেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ওটা কোনো অতীতের চলার পথ। ঐ পরিত্যক্ত পথের শেষে ঘনজঙ্গলে আর আগাছায় ঢাকা একটা বাড়ির ভগ্নাবশেষ। রবীনদা এসে ওই খন্ডহরটা দেখিয়ে জানালো, ‘ওটা নয়ন সিং-য়ের বাড়ি ছিল। লোকটা আজ আর নেই। ভাবতে পারিস, ঐ থুত্থুরে বুড়োটা একসময় আজাদ হিন্দ্ ফৌজের সেপাই ছিল। ওর সংগ্রহে রাখা জরাজীর্ণ ইউনিফর্ম্ , মেডাল আর আই,এন,এ,-র টুপিটা আমি স্বচক্ষে দেখেছি।’
একসময় সবাই নেমে এসেছি বিরমাতা গ্রামে। ব্রিজ পেরিয়ে কিছুটা হেঁটেই সিমেন্টের তৈরী আলুর বস্তার গুদামঘর। তার পাশেই পাঁচশো ফুট নিচে নদি পর্যন্ত নেমে গেছে বোল্ডার বাঁধানো বিসর্পিল পথ। নিচে একটা বড়সড়, ছিমছাম স্কুলের পাশেই গুমান সিং -এর বাড়ি। ওটাই গোনা-বাগাড় গ্রাম। গুমান সিং বাড়ির লনে আমাদের অপেক্ষাতেই বসে ছিল। ও আমাদের একদিন আগেই চলে এসেছে।
সে রাত গুমান সিং -য়ের অসাধারণ আতিথ্যে কেটেছে।
সকালে প্রাতরাশ, প্রাতঃকৃত্য শেষ হ’বার পর স্যাক নিয়ে সবাই উঠে এসেছি ওপরের রাস্তায়। ওখানে আমাদের জন্যে চামোলি যাবার ট্রেকার অপেক্ষা করছিল। মালপত্র গাড়িতে তুলে গুমান সিং কে বিদায় জানিয়েছি।
বিরহি গঙ্গার সেতু পেরিয়ে গাড়ি বাঁক নিয়েছে সর্পিল পাহাড়ি পথ ধরে। কুড়ি মিনিট পর পরই ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম। কিছুক্ষণ পর পরই স্কুলের পথে যাওয়া ইউনিফর্ম পরা কিশোর কিশোরীরা। রবীনদা ফ্রন্ট সিট থেকে সেদিকে আঙুল তুলে বলল, ‘দ্যাখ্ সজল, আজ যখন দেখি দূর-দূরান্ত থেকে ছেলে মেয়েরা স্কুলে পড়তে আসছে, রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো হয়েছে, কুসংস্কারের অন্ধকার অনেকটা কেটে গেছে ; তখন যে কতটা তৃপ্তি হয়, বলে বোঝানো যায় না। সজলদা বলল, ‘সবই তো বুঝলাম বাঁড়ুজ্যে, কিন্তু নেপথ্যের কারনটা যে এখনো রহস্যই রয়ে গেল।’
আমার অবশ্য মনে হচ্ছিল অন্য কথা। গাড়ি চলাচলের এই পাহাড়ি সড়কের আশপাশ থেকে পায়ে চলা, সংকীর্ণ কত পথ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে, কোথায়, জানি না। হয়তো কখনো কারো জীবন ঐ পায়ে চলা কোনো পথ ধরে খুঁজে পায় নতুন তৃপ্তি, অনন্য প্রাপ্তির অপ্রত্যাশিত কোনো অনাঘ্রাত উপত্যকা। রবীনদার পাওয়া এই এক টুকরো স্বর্গের পেছনে কারন খোঁজাটা অনর্থক। আমি আর জানতে চাই না।